• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

Friday, July 31, 2015

অধীশা সরকার

কাঠবাদামের গন্ধ 

১০

সামনে পাঁচটা কফির কাপ, অ্যাশট্রে ভর্ত্তি আধপোড়া সিগারেট, ল্যাপটপের ওপর বিবির আঙ্গুলগুলো খুব দ্রুতগতিতে চলছে। ল্যাপটপটা নীলের। সিসিডির বারান্দায় বসে নীলের নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইডিয়েট মনে হচ্ছে, কারণ একটা অনগোয়িং কেসের প্রায় সমস্ত ডিটেল ও একটা অচেনা মেয়েকে বলে ফেলেছে। কেস ফাইলটা এখন ওরই সামনে ল্যাপটপ স্ক্রিনে। যে নামটা বলেছে সেটাও আসল নাম কিনা নীল শিওর নয়। কোনো মানে হয়? কোনোওওও মানে হয়??
বিবি কিছুক্ষনের জন্য থেমে চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে পরপর দুটো রিং ছাড়ল। পাথরের তৈরী চোখদুটো এখনো ল্যাপটপ স্ক্রিনে। নীলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল তাহলে... তুমি বলছ... সকলকে জেরা করা হয়ে গেছে। কাজের লোকেদের অ্যালিবাই সলিড, ছেলের কোনো অ্যালিবাই নেই কিন্তু কোনো মোটিভও নেই, পুরনো ম্যানেজার বিশ্বস্ত, তাই সাসপেক্ট হল নতুন যে ছেলেটি কাজে ঢুকেছে, এই তো?
-    হুম...
-    অ্যারেস্ট করেছ?
-    কিসের বেসিসে? ওরও কোনো মোটিভ নেই। মোটিভ ব্যাপারটা জাস্ট পাওয়া যাচ্ছে না, এক যদি না কোনো গোপন লকার-ফকার থেকে মালকড়ি সরিয়ে থাকে। বাট ইন দ্যাট কেস...
-    দাঁড়াও বাবা... ধীরে। মালকড়ি কে সরাতে পারে বলে ভাবছ?
-    কেন, ওই নতুন ছেলেটা? কি যেন নাম...
-    পুরনোজন নয় কেন? শিবাশিষবাবু? অথবা... ফর দ্যাট ম্যাটার... ছেলেই বা সাসপেক্ট নয় কেন যদি টাকাপয়সাই মোটিভ হয়ে থাকে?
-    ছেলে কেন হঠাৎ বাপের টাকা চুরি করবে? রিডিকিউলাস! আর শিবাষিশবাবু অনেক পুরনো স্টাফ, আমিও ওনাকে চিনি অনেক আগে থেকেই। চুরি করার হলে এতদিন করেননি কেন?
বিবি কিছুই বলল না উত্তরে। ওই ঠোঁটচেরা হাসিটা হাসল নীলের দিকে তাকিয়ে। নীল হঠাৎ ধন্ধে পড়ে গেল। মেয়েটা কি খুব আকর্ষনীয়? নীলকে বশ করে সব ইনফরমেশন হাতিয়ে নিচ্ছে? অথচ নীল মেয়েটার প্রতি কোনো আকর্ষণ বোধ করছে না। ইন ফ্যাক্ট, একরকমের বিকর্ষণ বোধ করছে। আবার এও ঠিক যে মেয়েটা বশ করে ফেলেছে তাকে। নীলের আবার অজগরের মেটাফরটা মাথায় এল। মেয়েটা এসব কেন করছে? এই কেসে ও হঠাৎ ইন্টারেস্ট নিল কেন? আচ্ছা... মেয়েটার সঙ্গে নীলের যেদিন দেখা হল সেদিনই তো খুনটা... মানে তার আগের রাতে! আর ঠিক সেদিনই মেয়েটা ওকে... মিথ্যে বলে ওর সঙ্গে আলাপ করল ইন ফ্যাক্ট। এই মেয়েটা কে? হু ইজ শি? সেইদিন থেকে যা যা ঘটছে সবই একটা স্ক্রিপ্ট নয়তো যেটা বিবি লিখছে?
ঘোর কেটে গেল কারণ বিবি বলে উঠল, চলো, যাওয়া যাক
-    কোথায়?
-    ক্রাইম সিন।
গাড়িতে বসে নীলের একটা চিনচিনে ভয় হল। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল কাজটা করতে যাচ্ছে না সবচেয়ে বড় ঠিক কাজটা? সমস্ত প্রোটোকল ভেঙ্গে এই মেয়েটাকে... বিবিকে... জড়াচ্ছে এই কেসে। সর্বনাশ হবে না তো? ঠিক তখনই বিবি পাশ থেকে বলে উঠল, আমরা অনেকসময়ে যাকে সবচেয়ে ভালো করে চিনি বলে মনে করি সেই সবচেয়ে অচেনা হয়ে যায়
-    জ্ঞান দিও না, প্লিজ।
-    উঁহু, জ্ঞান দিচ্ছি না। ভাবছি সাইনাইডটা এলো কোত্থেকে?
-    সাইনাইডের সঙ্গে চেনা-অচেনার কি সম্পর্ক?
-    আছে... আছে... না থাকলে আর বলব কেন? আমার মনে হচ্ছে, ভীষণভাবে মনে হচ্ছে, চুরি একটা হয়েছে। তবে টাকা নয়।
-    টাকা নয় তো কি চুরি হবে আবার?
-    চলো, দেখা যাবে।
অরুনকাকুর বাড়িতে ঢুকেই বিবি সোজা গেল বেডরুমে। কাজের মেয়েটাকে নিজেই হুকুম করল নতুন ম্যানেজারবাবুকে ডেকে দিতে। ছেলেটার নাম অর্জুন বড়াল। বয়স ২৫-২৬ হবে। খুব কুঁকড়ে-মুকড়ে এসে দাঁড়াল। ভয়ে মুখ শুকিয়ে আছে। সে সম্ভবত আঁচ করেছে সন্দেহ তার দিকে। তাকে দুরাউন্ড জেরা করা হয়েছে, অন্যদের এক রাউন্ড। সে সম্ভবত তিন নম্বর রাউন্ডের জন্য তৈরী হয়ে এসেছে। নীল তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করল ছেলেটাকে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ কি বলছে? ছেলেটা খুব ভয় পেয়েছে। আদৌ ভয় পেয়েছে কি? নাকি এটা অভিনয়? ইনোসেন্ট সাজার জন্য। বিবি কিন্তু ছেলেটার দিকে তাকায়নি এখনো। ঘরটাই দেখে যাচ্ছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এত কি দেখার আছে কে জানে। ফরেনসিক টিম এই ঘরের এক ইঞ্চিও বাদ দেয়নি।
অরুণবাবু ঠিক কি লিখছিলেন যার প্রুফ দেখছেন আপনি? বিবির আচমকা প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল ছেলেটা।
-    আ-আসলে বই একটা লিখছিলেন নক্সালদের ওপর...
-    এই বইয়ের মেটিরিয়াল কোত্থেকে আসছিল? পুলিশের ফাইল?
-    না... আসলে... একটা পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট মত... ওনার ডাইরি থেকে...
-    উনি ডাইরি লিখতেন?
-    হ্যাঁ... কেরিয়ারের প্রথম থেকেই লিখতেন আর কি। সেখান থেকে নিয়ে কম্পাইল করে, এডিট করে...
-    গট ইট। ডাইরিগুলো কোথায়?
-    এই তো... এই কাবার্ডে...
কাবার্ড খোলা হল। ভদ্রলোক দৃশ্যতই খুব সিস্টেম্যাটিক ছিলেন। তারিখ অনুযায়ী সাজানো কালো চামড়ার ডাইরি প্রায় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশটা হবে। বছরগুলো সোনালি অক্ষরে স্পাইনে লেখা। বিবি একটা ডাইরিতেও হাত দিল না। খোলা কাবার্ডটার দিকে ঠিক দুমিনিট তাকিয়ে রইল। তারপর সশব্দে সেটা বন্ধ করে বলল ১৯৮০ সালের ডাইরিটা মিসিং। ওটা বা ওটার অংশবিশেষ এবাড়ির কারো ঘরে পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। যদি না... আচ্ছা দেখা যাক। এই মূহুর্তে সবার ঘর সার্চ করাও এক এক করে। যদিও... উই মাইট বি টু লেট...
থ-মারা ভাবটা কাটিয়ে নীল নিজে আবার কাবার্ড খুলল। বিবির বিরক্তিসূচক এক্সপ্রেশন অগ্রাহ্য করে। ১৯৮০ সালের ডাইরিটা সত্যিই মিসিং। উনআশি সালের পর দেখা যাচ্ছে একাশি। নীল কাবার্ড বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইতিমধ্যে বিবি অর্জুনকে বলতে শুরু করেছে, আপনার ঘর দিয়েই শুরু করা যাক। পুলিশ আপনাকেই প্রাইম সাসপেক্ট মনে করে, জানেন তো? নীল আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

১১

অর্জুনের ঘরে কিছু পাওয়া গেল না। অংশুমানের প্রবল আপত্তি ডিঙ্গিয়ে তার ঘরও সার্চ করা হল। অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে সে বলল, হিউম্যান রাইট বলে একটা ব্যাপার আছে জানেন বোধ করি? সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া... বিবি একমনে তার ঘরটাও স্টাডি করছিল। অন্যমনস্কভাবে বলল হুঁ... কিন্তু আপনার বাবা তো আপনাকে কিছুই দিয়ে গেলেন না। এরপর আপনার চলবে কি করে? আপনার তো সে বিষয়ে বেশী ভাবনা হওয়া উচিৎমানে!? অংশুমান রীতিমত খেপে উঠল এবার। বিবি খুব মিষ্টি করে হাসল। কিছু না। আপনি সিনেমাটা ভালই বোঝেন। কিন্তু বানাতে জানেন না
শেষ সার্চ করা হল শিবাশিষবাবুর ঘর। উনি বাড়িতে নেই, কিছু কাজে বেরিয়েছেন। খানিক্ষণ অপেক্ষা করে নীল অর্জুনকে বলল তালা ভাঙ্গতে। কিন্তু তালা ভাঙ্গার আগেই... বিবির চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। ঘরে ঢুকেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ পেল নীল। একটু পোড়া পোড়া একটা কড়া গন্ধ কিসের, সেটা ঠিক... সে বিবির দিকে তাকাল। বিবি জোরে জোরে নাক টানছে। ঠিক শিকারী কুকুররা যেমন করে। ঘরটা আবছা অন্ধকার মত, বাড়ির পেছনদিকে বলে আলো ঢুকছে না তত। সেই আবছায়ায় নীলের হঠাৎ মনে হল, বিবির চোখ দুটো জ্বলছে। পশুর চোখ অন্ধকারে জ্বলে। নীল আলোর সুইচটার জন্য দেওয়াল হাতড়াচ্ছে, আর ততক্ষণে বিবি টান মেরে একটা টেবিলক্লথ সরিয়ে পুরনো টেবিলটার নীচে আবিস্কার করে ফেলেছে কিছু কাঁচের সরঞ্জাম আলো জ্বলতে দেখা গেল, একটা বুনসেন বার্নার, কিছু কাঁচের শিশিবোতল। ফ্যাসফেসে গলায় বিবি বলল হুঁ... লিকুইড হাইড্রোজেন সাইনাইড... কাঠবাদামের গন্ধ। জানলাগুলো খুলে দাও। নাকে রুমাল দিয়ে রাখো। যদিও এখন আর...
-    শিবাশিষবাবু!
-    হুঁ, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, ভেরি ক্লেভারলি ডান। পাইপটা থেকে প্রিন্ট নিয়েছিলে তো তোমরা? কিন্তু পাইপের ভেতরের টোব্যাকোটা কি চেক করেছিলে? এবার করো, সাইনাইড ওখানেই পাবে। ওনার কাবার্ডের ওপর ডানদিকে টেবিল ল্যাম্পের পাশে টোব্যাকো পাউচটা দেখলাম। ওটাই সোর্স। ওখানেও পাবে।
-    কিন্তু... মোটিভটা কি?
-    ডাইরি। ওয়েট...
বিবি এবার ঘরের পেছনের দরজাটা খুলে একটা উঠোনমত যায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। এই যায়গাটা নীল কখনো দেখেনি, কারণ এটা বাড়ির একদম পেছন দিক। এখানে যে একটা কুয়ো আছে, সেটা কেমন অদ্ভুত ঠেকল। সাবেকি বাড়ির স্মৃতিচিহ্ণ। বিবি কুয়োটার মধ্যে অর্ধেকটা শরীর ঝুঁকিয়ে দিয়েছে তার হাতে একটা ছোট লাঠি গোছের জিনিস। নীলের কিরকম একটা লাগছে। এসব কি হচ্ছে? শিবাশিষবাবু...
বিবি লাঠিটা দিয়ে খুঁচিয়ে শ্যাওলামাখা কি একটা তুলে এনেছে কুয়ো থেকে। ঘরের বাইরে এসে পাশের একটা বেসিনে শ্যাওলাটা ধুয়ে ফেলতে দেখা গেল, একটা ডাইরির স্পাইন এবং মলাটের কিছুটা অবশিষ্ট অংশ। যার ওপর লেখা আছে ১৯৮০। ডাইরিটা পোড়ানো হয়েছিল। ভেতরে পাতা বলে কিছু আর নেই।
ওরা বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। নীলের হাতে সিগারেটটা পুড়ে যাচ্ছে, মুখ অবধি উঠছে না। বিবি ক্রমাগত রিং ছাড়ছে যদিও। তার দৃষ্টি স্থির। খানিক্ষণ চুপ করে থাকার পর নীল বলে উঠল, অনেকটা স্বগোক্তির মত কিন্তু... কেন?
-    অবভিয়াসলি, ডাইরিতে এমন কিছু ছিল যা ছাপা হলে ওনার অসুবিধে হত।
-    কি ছিল?
-    সেটা তো উনিই বলতে পারবেন।
-    হ্যাঁ... হ্যাঁ... অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট... ওনার ফোন সুইচড অফ বলছে... ফলে...
-    সত্তরের দশকের নক্সালদের কেউ কেউ এখনো বেঁচেবর্তে আছে... তাদের কারো একটা বাড়িতে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর নয়তো...
-    এক মিনিট। শিবাশিষবাবুকে এক্স-নক্সালদের বাড়িতে কেন পাওয়া যাবে?
-    কারণ উনি নিজে তখনকার নক্সাল।
-    সেটা তুমি জানলে কি করে?
-    সিম্পল হোমওয়ার্ক। তোমাদের ফাইল ঘাঁটলাম, আর কিছুই না।
-    আমাদের ফাইল মানে? পুলিশ রেকর্ড? তুমি কিকরে পাবে সেটা?
-    এখন সবকিছু ডিজিটাইজড হয়ে গিয়ে খুব ভালো হয়েছে। তোমাদের আর্কাইভটাও মন্দ করেনি। মোটামুটি ডেটা তুলে দিয়েছে। পুলিশ কাজ করে না একথা ঠিক না। সব পুলিশ করে না আর কি।
-    কিন্তু সেই আর্কাইভ তুমি অ্যাক্সেস করলে কি করে!!??
-    খুব আলতো করে হ্যাক করলাম আর কি। কোনো প্রবলেম হয়নি। কেউ বুঝবেও না। ডোন্ট ওয়ারি। তো... আমার প্রথম ওনাকে সন্দেহ হয় ওনার ছবি দেখে। ওনার মুখের যা গড়ন এবং অভিব্যক্তি, তা বলে দেয় উনি বেশ কঠিন লোক। অথচ মুখে একটা আর্টিফিশিয়াল নমনীয়তা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ওনার চুলের সিঁথির টেন্ডেন্সি স্বাভাবিক নিয়মে মুখের গড়ন অনুযায়ী বাঁদিকে হবে, কিন্তু করা হয়েছে ডানদিকে। ছবিতে এটুকুই বোঝা গেল। কিন্তু খটকার জন্য ওটাই এনাফ ছিল। তারপর ওনার বয়েস আন্দাজ করে সেই অনুযায়ী একটা স্পেসিফিক পিরিয়ডের নক্সালদের ফাইল দেখতে গিয়ে সুকান্ত লাহিড়িকে পেলাম। ওনার আসল নাম। চেহারা একদম বদলে ফেলেছেন। কিন্তু চোখ তো মানুষ বদলাতে পারে না। এদিকে তোমার ফাইলে ওনার এখনকার ছবি তো ছিলই। একটা ফেস রেকগনিশন সফটওয়ারে দুটো ছবি ম্যাচ করিয়ে...
-    তুমি কলকাতা পুলিশের সার্ভার হ্যাক করেছ??? 
-    হ্যাঁ, বললাম তো। তোমাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হলে অনেক ফালতু প্রশ্ন করতে। টাইম ওয়েস্ট। প্লাস খুঁজতেও অনেক বেশী সময় নিতে। তাই।
-    তুমি...
-    আমি একজন হ্যাকার। কিন্তু যা করছি তোমাকে হেল্প করার জন্যই করছি। অকৃতজ্ঞের মত আমাকে অ্যারেস্ট কোরো না দয়া করে।
হাতে একটা ছ্যাঁকা খেয়ে নীল সিগারেটটা ফেলে দিল। আর ঠিক তখনই একটা ফোন এল। অরুণকাকুর মেয়ে কলকাতা পৌঁছে গেছে। পার্ক হোটেলে আছে। ইমিডিয়েটলি দেখা করতে চায়।

১২/

গাড়িটা জ্যামে আটকে আছে। জট শুধু রাস্তাতেই পড়েনি, নীলের মাথায়ও পড়েছে। এবং বেশ ভালোরকম। যদিও, এখন আর এই জট ছাড়ানোর আর কোনো প্র্যাকটিকাল কারণ নেই। কেসটা সল্ভড হয়ে গেছে। পুলিশ শিবাশিষ হালদারকে খুঁজছে। এত তাড়াতাড়ি এত কিছু ঘটে গেল... যে... আর ঐ যে, বিবি! মেয়েটা কে সেটাই জানতে পারল না এখনো। অথচ কেসটা সল্ভ করে দিল মেয়েটা। নীল যেটা কিছুতেই পারত না। বলল, হ্যাকার! সত্যিই হ্যাকার? নাকি ওটাও গুল? আজ দুপুরে ওক্কে, দেখা হবে বলে হঠাৎ দৌড়ে একটা বাসে উঠে গেল। নীল কি করবে ভেবে পেল না।
মাথার জটটার আর একটা কারণ অরুন্ধতি বন্দ্যোপাধ্যায়। মানে, অরুণকাকুর মেয়ে। যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে নীল এখন। সে ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে এই মহিলাকে। যে... তাঁর বাবা খুন হয়েছেন। তারপর খুনের বর্ননাও দিতে হবে... কিভাবে এটা করতে হয় নীল জানে না। একটা মেয়েকে সে বলবে তার বাবা মারা গেছে... খুন হয়েছে... তারপরেও নির্বিকার থেকে বলতে হবে কিভাবে... ধুর! পুলিশের চাকরিটা করা যে কি ভীষণরকম ভুল হয়েছে নীল আরেকবার নিজেকে মনে করিয়ে দিল। ওদিকে জট খুলেছে। আবার স্টিয়ারিং-এ মন দিল সে।
পার্ক হোটেলের লবিতে যখন ঢুকছে তখনো মাথার মধ্যে ঘনঘোর মেঘ। কিন্তু লবিতে ঢুকেই বিদ্যুৎ চমকালো। কারণ নীল দেখল একটা সোফার ওপর বেশ কায়দা করে পা তুলে বসে আছে বিদ্যুৎলতা বটব্যাল।
-    তুমি এখানে কি করছ!
-    এমনিই এলাম।
-    এলে মানে? তুমি জানলে কি করে আমি এখানে আসব?
-    আজ দুপুরে আমার সামনেই কথা হয়েছে, ভুলে গেছ?
-    ও... হ্যাঁ... কিন্তু... তুমি এখানে কেন? অন্য কোথাও তো দেখা করতে পারতে।
-    তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম, কিন্তু তোমার সঙ্গে দেখা করতে তো আসিনি।
-    মানে?? শোনো, তোমার কোনো কথা আমি বুঝতে পারি না।
-    সব কথা যে বুঝতে হবে তারও কোনো মানে নেই। খালি কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখো। এক, কেস কিন্তু তোমার এখনো সল্ভ হয়নি।
-    সে আবার কি? কেস তো সল্ভ হয়ে গেছে!
-    উফফ... এই তো ইডিয়েটের মত... যাকগে। সরি। কেস কি করে সল্ভ হয়ে গেছে? একটাই মানুষ খুন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু খুনি তো দুজন। ভুলে গেছ? একজনকে তুমি ধরেছ, অলমোস্ট, কিন্তু আরেকজন?
-    দুজন মানে?
-    সিরিয়াসলি... মাঝে মাঝে মনে হয় ক্লাস ফোরের বাচ্চাকে বোঝাতে হচ্ছে। খুবই পরিশ্রমের কাজ। সাইনাইড দিয়ে যে মেরেছে, সে কি গলাও কাটবে নাকি আরেকবার? স্পেশালি এমন একজন লোক যে হাইড্রোজেন সাইনাইড বানাতে বা সেটার লিকুইড ফর্ম তৈরী করতে সক্ষম? ওই বিষের এফেক্ট সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ থাকার তো কথা নয় তার। তাহলে? গলাটা কাটল কে?
-    তুমি বলতে চাইছ আরেকজন অরুনকাকুকে মার্ডার করতে এসেছিল!
-    শুধু তাই নয়, তার হয়তো ধারণা মার্ডারটা সেই করেছে। এবার, আরো কয়েকটা জিনিস ঝালিয়ে নেওয়া যাক, ওকে? শার্প ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে গলা কাটা হয়েছে, যেটা ছুরি নয়। অরুনবাবুর ঘরে কোনো লুকনো লকার নেই। এবং, তাঁর ঘরে এমনকি কোনো টাকাপয়সাও রাখা থাকে না। ওনার ঘরে অনেক ফ্যামিলি ফোটোগ্রাফ আছে। তার কয়েকটাতে একজনের ছবি মিসিং। এবার, শেষ সুত্র। হাইড্রোজেন সাইনাইডের একটা তীব্র গন্ধ আছে। কাঠবাদামের গন্ধ। কিন্তু সেই গন্ধ সবাই পায় না। যেমন, তুমি পাওনি। আবার অংশুমান গন্ধটা পেয়েছিল, কারণ আমি যখন সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামছি ও আমাকে ক্রস করেই উঠছিল, এবং তখনই নাক টানছিল। গন্ধটা আমিও পেয়েছি। এই সাইনাইডের গন্ধ পাওয়ার ব্যাপারটা জেনেটিক। এবার বলো, কি বুঝলে?
নীল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খানিক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর হাল-ছেড়ে-দেওয়া গলায় বলল, আমাকে এখন অরুন্ধতি বন্দ্যোপাধ্যায়, মানে অরুণকাকুর মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে হবেই। তুমি কি করতে চাও এখন বলো? বিবি কিছুক্ষণ হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। খুব দুঃখিতভাবে আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকাল। তারপর বলল, আমিও ঠিক সেটাই করতে চাই। অরুন্ধতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা
নীল লিফটে উঠল মাথার মধ্যে একটা এমন জট নিয়ে, যেটা ছাড়ানোর সমস্ত আশাই সে একরকম ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু লিফটের দরজাটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নীলের মনে পড়ল, দুপুরে বিবি অংশুমানকে বলছিল অরুণকাকু ওর জন্য কিছুই রেখে যাননি। তখন খেয়াল হয়নি নীলের, এখন মনে হল, এটা বিবি জানে কিভাবে? ও নিজেও তো জানে না এরকম কিছু। জট আরো ঘন হয়ে উঠল। এটা ডিটেক্টিভ নভেল হলে ঠিক এই যায়গায় বলা হত, দ্য প্লট থিকেনস। পাঠকের জন্য বোধয় দারুণ হয় ব্যাপারটা, কিন্তু নীলের মোটেও ভালো লাগছে না এসব।
রুম নাম্বার ৩০১। বেল বাজাতে উনি দরজা খুললেন। পালিশ করা চেহারা। ব্যক্তিত্ব শব্দটার পার্সোনিফিকেশন। খুব শান্ত ভঙ্গি। কিন্তু ফোলা চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মন ততটা শান্ত নেই। খবর তো উনি ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। এটা জাস্ট একটা ফর্মাল কনফার্মেশন।
-    আসুন ইন্সপেক্টর...
-    আমাকে নীল বলুন প্লিজ। অরুণকাকুকে ছোটবেলা থেকে চিনি। আপনাকেও দুএকবার দেখেছি আগে... হয়তো আপনার মনে নেই। দেখুন...
-    এক মিনিট। আপনার কি নেবেন? চা... কফি...
নীল হাঁহাঁ করে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বিবি বলল, কফি। অরুন্ধতী এতক্ষণ বিবিকে খেয়াল করেননি। এবার তাকালেন। ওর দিকে তাকিয়েই ফোন তুলে অর্ডার দিলেন। ফোন রেখে বললেন, বসুন
নীল বসে পড়ে মনে মনে নিজেকে বেশ করে গালাগাল দিল। এই আপদটাকে নিয়ে আসার আদৌ কোনো দরকার ছিল? কিন্তু...
বিবি বসেনি। সে পায়চারি করছে। একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন ভয় পেয়ে গেল নীল। কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওকে। সুন্দর নয়, ভিশাস। অরুন্ধতী কিন্তু খুব শান্তভাবে দেখছেন বিবিকে। আরেকবার বললেন, কই, বসুন?
-    নো থ্যাঙ্কস। যে ব্যাপারটা কথা বলে সল্ভ করা যেত তার জন্য খুন করার কি খুব দরকার ছিল?
ঘরে পিন ড্রপ সাইলেন্স। নীল এতটা বোধয় জীবনে কোনোদিন চমকায়নি। সে অরুন্ধতীর দিকে তাকাল। তিনি নিষ্পলক চোখে বিবিকে দেখছেন। বেশ খানিক্ষণ পর বললেন, মানে?
-    মানে... আপনি যদি আপনার বাবাকে বুঝিয়ে বলতেন যে আপনার ডিভোর্সটা ইনেভিটেবল ছিল, আপনি কারো সঙ্গে থাকতে না চাইলে তাকে ছাড়ার অধিকার আপনার আছে, উনি প্রথমে মানতে না চাইলেও একসময়ে মানতেন ঠিকই। কিন্তু, আপনি সেই রিস্কটা নিতে পারলেন না। উইলটা একবার বদলে গেলে সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাবে বলে ভয় পেলেন? অবশ্য... নিজের বাবা হলে আপনি এটা করতে পারতেন না বোধয়। অথবা, কে জানে, পারতেও পারতেন হয়তো।
এবার নীল আর থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়াল এসব কি বলছটা কি তুমি??! বিবি এবার নীলের দিকে তাকাল। তার চোখটা এখনো পাথরেরই।
-    নীল, ঘরে ঢুকেই আগে ঘরটা লক্ষ্য করবে। তারপর মানুষটাকে। এ ঘরে সোফার ওপর একটা হ্যান্ডব্যাগ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু হ্যান্ডব্যাগে কোনো লাগেজ ট্যাগ নেই। যিনি বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে আজ সকালে কলকাতায় ল্যান্ড করেছেন, তিনি কি স্বাভাবিকভাবে ইতিমধ্যেই হ্যান্ডব্যাগের লাগেজ ট্যাগটা খুলে রাখার মত তুচ্ছ কাজটা সেরে রাখবেন? তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, রাখতেও পারেন। কিন্তু একটা লাগেজ ট্যাগ যে উঁকি মারছে খাটের তলা থেকে, সেটা বোধয় স্যুটকেসেরটা। ওটা উনি বিগত পাঁচদিনে খুলে রাখার সময় পাননি বোধয়। বা ওটাকে অত গুরুত্ব দেননি। আমি এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি, তুমি বরং কাছে গিয়ে দেখো, ওটার ওপর যে তারিখের স্ট্যাম্পটা মারা আছে, সেটা পাঁচদিন আগেকার তারিখ। উনি পার্ক হোটেলে আজ সকালেই চেক-ইন করেছেন আমি শিওর। কিন্তু কলকাতায় আজ সকালে উনি পৌঁছোননি। ওই স্যুটকেসটা একটু সার্চ করো। ইফ উই আর লাকি, ওর মধ্যে একটা স্ক্যালপেল পাওয়া যাবে। মার্ডার ইন্সট্রুমেন্ট।    
নীলের মাথা ঘুরছে। হতভম্ভ হয়ে সে প্রথমে ঝুঁকে পড়ে খাটের তলা থেকে টেনে বার করল লাগেজ ট্যাগটা। তারপর তাকাল অরুন্ধতীর মুখের দিকে। ওই শান্ত, ব্যক্তিত্বময় মুখটা দুমড়ে-মুচড়ে যে অতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, নীল চোখের সামনে না দেখলে ভাবতেও পারত না।

১৩

সুকান্ত লাহিড়িকে কলুটোলা থেকে অ্যারেস্ট করে আনা হয়েছে। বাধা দেওয়ার চেষ্টাও করেনি লোকটা। ইন্টারোগেশন রুমে এক কাপ চা হাতে করে ঢুকল নীল। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে ওনার হাতে দিল। তারপর শুধু একটাই প্রশ্ন করল, কেন?
সুকান্ত গড়গড় করে বলতে শুরু করল। কোনো আপত্তি করল না। 
-    আমি যে নক্সালকর্মী সেটা তো বোধয় আপনারা এতক্ষণে জানেন। অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু, কমরেডস, প্রাণ হারিয়েছে। হ্যাঁ, আপনাদের শ্রদ্ধেয় কমিশনার সাহেব নিজের হাতে গুলি করে মেরেছে তাদের। অবশ্য, সেটাকে তো আপনারা মার্ডার বলবেন না। ঝিমলির মা তখন বছরখানেক হল মারা গেছে। জেলে থার্ড ডিগ্রি দিয়েছিল ওকে। বাড়ি এসে সোজা হয়ে হাঁটতে পারত না। কদিন পর রক্তবমি করতে করতে... যাকগে। আমি তিন বছরের ঝিমলিকে নিয়েই থাকি। যখন বেরোই, পাশের বাড়ির মাসিমা দেখে। সেদিন পুলিশ যখন রেড করল আমাকে পালাতে হল। মাসিমাও ওদিকে পুলিশ দেখে পালিয়েছে। মেয়েটা ভয় পেয়ে খোলা দরজা দিয়ে ছুট্টে বেরিয়ে একেবারে বাঘের মুখে। কমিশনারের গাড়ির সামনে। পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় মেয়েটাকে গাড়িতে তুলে নিল। তারপর আর দেখিনি ওকে। ধরেই নিয়েছিলাম, ও ওর মায়ের মতই... তারপর অনেকদিন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকলাম। মাঝেমাঝেই নানারকম উড়ো খবর পেতাম। যখন বেরোলাম, তখন তল্লাটে কেউ যাতে আমায় চিনতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হল। নতুন নাম, নতুন মুখ। ঝিমলির খোঁজ হঠাৎ করেই পেলাম। একদিন দেখলাম ওকে রাস্তায়। স্কুল থেকে ফিরছিল। অনেক বড় হয়ে গেছে, কিন্তু আমার তো মেয়ে। চিনতে পারব না? ফলো করে গিয়ে দেখি সে অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ঢুকল। শুনলাম, লোকে নাকি ঝিমলিকে ওনার মেয়ে বলেই চেনে। বিশ্বাস করুন, আমি ওই অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুন করার প্ল্যানই করেছিলাম। কিন্তু যখন শুনলাম আমার মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মত মানুষ করেছে... একদিন সোজা গিয়ে ওই লোকের কাছেই চাকরির দরখাস্ত করি। সে আমাকে চিনতেও পারেনি, পারার কথাও না। মেয়েটাকে দেখতে পেতাম দুবেলা... সব ভুলে যাচ্ছিলাম। তারপর সে তো চলে গেল বিদেশ, পড়তে। ওখানেই থেকেও গেল। কিন্তু আমিও ওবাড়ি ছাড়লাম না। যখন আসে, ওবাড়িতেই তো আসে।
একদিন শুনি, অরুণবাবুর তার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে ফোনে। কাকে সে নাকি বিয়ে করেছে, তাকে এখন ডিভোর্স করতে চায়। আমি শুনে থ... আমার মেয়ে বিয়ে করেছে? আমি তো সেটাই জানিনা! ওদিকে শুনলাম অরুণবাবু তড়পাচ্ছে ডিভোর্স যদি করো আমার সম্পত্তির এক পয়সাও তুমি পাবে না! মাথায় আগুন ধরে গেল, বুঝলেন? নিজের মেয়ে হলে বলতে পারত এই কথা? ঝিমলি কাকে বিয়ে করবে, কাকে ডিভোর্স করবে, ওর ব্যাপার। তাই বলে হুমকি দেবে ওকে? সম্পত্তি দেখাচ্ছে! ঘুষের সম্পত্তি! তারপর... মনে পড়ল পেস্টিসাইড থেকে লিকুইড সাইনাইড এক্সট্র্যাক্ট করার ট্রেনিং। নক্সালদের অনেক কিছু জানতে হত... বুঝলেন তো?
আলগা হাসল লোকটা। সুকান্ত লাহিড়ি। সত্তরের দশকের ডাকসাইটে নক্সাল।
-    ডাইরিটা সরালেন কেন?
-    ওই ডাইরিতেই তো লেখা ছিল আমার ঝিমলি ওর পালিত কন্যা। কিভাবে পেয়েছিল ওকে সেটা লেখা ছিল। ওটা পাওয়া গেলে ঝিমলির তো আর কোনো দাবী থাকত না...
-    আপনি কি জানেন, অরুণবাবু ওনার সব সম্পত্তি মেয়ের নামেই লিখে দিয়েছিলেন, ছেলেকে এক পয়সাও দেননি?
-    জানি... কিন্তু ওই যে... সেই তুলে হুমকি দেবে কেন? ক্ষমতা একটা নেশা, জানেন তো? অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল সেই নেশা।
-    এখন তো পুলিশকে সব বলে দিলেন। এরপর তো মেয়ে আর পাবে না কিছু?
-    বললাম তো সেইজন্যেই। আমার মেয়ে হয়ে ও কি করল? লোভে পড়ে খুন করতে গেল? সেদিন রাতে আমিই দরজা খুলে দিয়েছিলাম ওকে। ও সেদিনই এসে পৌঁছল কিনা? বললাম ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, বাবা ঘুমোচ্ছেন। টোব্যাকো পাউচে সাইনাইড তার অনেক আগেই স্প্রে করে দিয়েছি। কিন্তু সকালে উঠে দেখি ঝিমলি নেই। আর তারপর শুনলাম গলা কেটে খুন। তখন বুঝলাম... ছি ছি! এ কি করল! লোকটা ওকে আশ্রয় দিয়েছিল...
আবার কফিশপ। এবার গড়িয়াহাট। এবং বিবি আবার ঘুমোচ্ছে। নীল কফি অর্ডার করে অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট পাঁচেক বাদে বিবি চোখ না খুলেই বলল, এবার সব পরিস্কার তো?
-    না, অনেক কিছুই পরিস্কার নয়।  
-    এখনো?
-    তুমি কেসটা সল্ভ করলে কি করে সেটা পরিস্কার নয়।
-    সেটা জানাটা খুবই জরুরি কি?
-    হ্যাঁ। আই ওয়ান্ট টু নো।
-    আমি তো তোমাকে বলেইছি আমি একজন হ্যাকার। আরো ডিটেলে জানতে চাও?
-    হুঁ, চাই।
-    অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইমেল হ্যাক করি। ওনার সঙ্গে ইমেল এক্সচেঞ্জ দেখে বুঝি এই অরুন্ধতী ওনার মেয়ে। সে এক সাহেবকে বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করে এখন ছমাসের মাথায় ডিভোর্স করতে চায়। বাবার সেটা একেবারেই পছন্দ নয়। তাকে আর্জেন্টলি দেশে আসতে বলেছেন। ত্যাজ্য করার হুমকিও দিয়েছেন। ওদিকে, দেখি লইয়ারের সঙ্গে আর একটা এক্সচেঞ্জ। উইল নিয়ে। উইল বদলাতে চাওয়া হয়েছে। উইলের কপি ডাউনলোড করলাম। আগের সোল নমিনি ছিল মেয়ে। উইল চেঞ্জ হওয়া আর মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া... মোটিভ। মেয়ে বাড়ির লোক। তার কাছে বাড়ির চাবি থাকার কথা, বা অন্য কারো সাহায্যে লুকিয়ে বাড়িতে ঢোকা অসম্ভব নয়। এবার অরুন্ধতীর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করলাম। শি ইজ আ ডক্টর বাই প্রোফেশন। শার্প ইন্সট্রুমেন্ট বাট নট আ নাইফ। স্ক্যালপেল।
-    আচ্ছা। হঠাৎ অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইমেল হ্যাক করলে কেন?
-    ওনার ঘরে ঢুকে আমি ছবিগুলো দেখছিলাম। ছেলের একদম কচি বয়সের ছবি আছে, মায়ের কোলে। কিন্তু মেয়ের ওই বয়সের কোনো ছবি নেই। প্লাস, মেয়েকে মায়ের সঙ্গে এক ফ্রেমে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। একটা ফ্রেমে দুজনে আছে অবশ্য, কিন্তু দুই কোনায়। মেয়ের প্রায় সব ছবি শুধু বাবার সঙ্গে। একটু অদ্ভুত, না?
-    শুধু এর বেসিসে?
-    এটা খটকা। ইন্সটিঙ্কট। খুঁড়ে দেখার জন্য ইমপিটাস আর কি।
-    কিন্তু তুমি কনফার্ম হলে কি করে যে অরুন্ধতী ওনার নিজের মেয়ে নয়?
-    ঠিক কনফার্ম নয়... কিন্তু প্রায় ৯০ ভাগ শিওর ছিলাম। ওই যে... কাঠবাদামের গন্ধ? যদি ধরে নিই গলা কাটতে মেয়ে এসেছিল, তাহলে সে গন্ধটা পেল না কেন যখন তার ভাই পেল? ডাক্তার হিসেবে তো গন্ধটা তার চেনারও কথা। আর গন্ধটা চিনে থাকলে নিশ্চয়ই গলা কাটার ঝামেলায় যেত না। তার মানে সে আর তার ভাই একই জিনে বিলং করে না। সিম্পল।
-    নট দ্যাট সিম্পল। তুমি যা বলছ সবই সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স। এর ওপর বেস করে...
-    ওইজন্যেই তো ওনার হোটেল রুমে ঢোকাটা খুব জরুরি ছিল। কনফার্ম ওখানেই হলাম। ওই যে, লাগেজ ট্যাগটা? তার আগে অবধি ব্যাপারটা ইন্টিউশনই ছিল। শিওর ছিলাম না। এবার হল তো ক্লিয়ার? না হলে আর কিছু বলার নেই। এবার আমাকে উঠতে হবে।
-    মানে? কোথায় যাচ্ছ?
-    সে দিয়ে তোমার কি?
-    না... মানে... আমি...
-    আমি একজন হ্যাকার। ক্রিমিনালই ধরো। পুলিশের সঙ্গে বেশী ওঠাবসা ভালো না আমার জন্য। চলি। আচ্ছা... আমাকে পাঁচশো টাকা দাও। আমার ফি।
নীল পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে টাকা এগিয়ে দিল। বিবি উঠতে যাবে, তখন হঠাৎ বলে উঠল,  
-    এক মিনিট... তুমি আমাকে সাহায্য করলে কেন?
বিবি কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। হাসল। তেরছা হাসি নয়, একটা সুন্দর, সরল হাসি। অন্তত সেরকমই দেখাল। তারপর হাঁটতে শুরু করল। নীল দেখল, গড়িয়াহাটের বিকেলবেলার জনস্রোতে আস্তে আস্তে একটা কালো অবয়ব বিন্দু হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎলতা বটব্যাল। হু ইজ শি?

(সমাপ্ত) 
          
My Blogger Tricks

0 comments:

Post a Comment