Friday, July 31, 2015
বুধের গায়ে গর্ত, আর সেই গর্তের নামকরণ হয়েছে কোনো বাঙালি চিত্রশিল্পীর
নামে, এতোটা সৌভাগ্য এপার বাংলার ক'জন শিল্পীর ভাগ্যে জোটে ? বড়জোর জন্মশতবর্ষে একখানা
'ডাকটিকিট' আর কয়েকটি প্রবন্ধ আর একটি 'রেট্রো'। সেই তুলনায় ইনি বেশ ভাগ্যবান, কাগজের
মুদ্রায় (আমাদের দেশে তো সেই লাঠি হাতে বৃদ্ধ ছাড়া কারোর কথাই ভাবা হয় না) ছাপা হয়েছে
তাঁর আঁকা ছবি, পাসপোর্ট ও ডাকটিকিট তো আছেই। গতবছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে মহা ধুমধামে পালিত
হয়েছে শিল্পীর জন্মশতবর্ষ, তবে ওপার বাংলায়। এপারে বিশেষ কোনো খবর নেই। আমাদের একটু
দেরিতে জাগা অভ্যাস। বাংলাদেশের নাগরিকরা এই শিল্পীকে ডাকেন 'শিল্পাচার্য' বলে, আমরা
চিনি শিল্পী জয়নুল আবেদিন নামে।
তবে শুরুটা কিন্তু মোটেই এতো সহজ সরল ছিলো না।
১৯১৪ সালে বর্তমান বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে এক সহকারী সাব-ইন্সপেক্টরের
ঘরে জন্মগ্রহণ করের জয়নুল আবেদিন। আর সাধারণ পাঁচটি শিশুর মতন এনার সম্পর্কে প্রতিবেশীদের
ধারণা "এই ছেলে বড়জোর আফিস কেরানী হবে বটেক" থেকে বেশি কিছুই এগোয় নি। ম্যাটিক
পরীক্ষার আগেই একাডেমিক পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে কলিকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস-এ
ভর্তি হন। পাঠ্যক্রমের শেষ বর্ষেই এই স্কুলের শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। বাংলার দুর্ভিক্ষ
(পঞ্চাশের মন্বন্তর) নিয়ে বিখ্যাত 'দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা' আঁকেন ১৯৪৩ সালে। দেশভাগের
পরে পূর্বপাকিস্তানে চলে আসেন।
১৯৫১ সালের আগষ্ট মাসে সরকারী বৃত্তি নিয়ে ইউরোপে যান জয়নুল আবেদিন।
বছরাধিককাল ব্যাপী সেখানে শিল্পকলার পাঠ নেন, প্রদর্শনী করেন এবং বিশ্বখ্যাত সমালোচক
দ্বারা প্রশংসিত হন। এই সময়ের উপলব্ধি প্রতিটি শিল্পীর শিক্ষণীয় ... "বিদেশে গিয়ে
আমার দেশকে চিনতে হয়। বিট্রিশ মিউজিয়ামে বাংলাদেশের মূল লোকশিল্পের প্রায় প্রতিনিধিত্বমূলক
সবগুলি নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। ওগুলো না দেখলে নিজের দেশকে বুঝতেই পারতাম না। দেশকে
আগে না বুঝে বিদেশে যাওয়া ঠিক নয়, তাহলে আমার মতো ঠোক্কর খেয়ে ফিরে আসতে হয়।"
উপলব্ধি মানুষকে তার লক্ষ্যস্থির করতে সাহায্য করেন। জয়নুলের মতন সংবেদনশীল
শিল্পীর কাছে সেটা প্রত্যাশিত। ১৯৫২ -এর সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ফিরলেন। ততদিনে বুঝে
গেছেন দেশজ শিল্পকে আত্মস্থ করে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছানোই তাঁর লক্ষ্য। দেশে থাকতে যে কাজ তিনি শুরু করেছিলেন বিশ্বখ্যাত
সমালোচক আর দর্শকদের প্রশংসা বাড়িয়েছে তাঁর আত্মবিশ্বাস।
১৯৫১-৫৩ সময়সীমাকে শিল্পসমালোচকরা চিহ্নিত করেছেন জয়নুল আবেদিনের 'বাঙালী
আধুনিক ধারা'র ছবি আঁকার সূচনা হিসাবে। বস্তুত বিদেশযাত্রার পূর্বের তিনি পুরুষ্ট তুলির
আঁচড়ে যে শিল্পধারা শুরু করেছিলেন, বিদেশ ভ্রমণ বিশেষ করে সংগ্রহশালা ও প্রদর্শনী কক্ষ
ঘুরে সেই ধারণা আরো মজবুত করেন। দেশে ফিরে
তিনি দুটি কাজ করলেন। এক, হাতে কলমে রসিক সমাজকে দেখালেন কিভাবে বাঙালী চিত্রকলার উত্তরণ
ঘটানো সম্ভব। দুই, এক স্থায়ী 'লোকশিল্পের সংগ্রহশালা' নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত
করা। সরকারি সহায়তায় তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয় মৃত্যুর ঠিক একবছর আগে । সোনারগাঁও -এ
নির্মিত হয় 'বাংলাদেশ লোকজ চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশন'। পট, পুতুল, নকশীকাঁথা, শোলাশিল্প,পিতল
শিল্প থেকে শুরু করে যাবতীয় লৌকিক শিল্পের নমুনা সংরক্ষণ করে গেলেন যা যুগ যুগ ধরে
বাঙালী শিল্পী, শিল্পরসিক এবং পন্ডিতদের সমৃদ্ধ করবে।
নিজের অধ্যবসায়ে তিনি হয়ে উঠলেন সব অর্থে শিল্পী। পেয়েছেন দেশ-বিদেশের
অসংখ্য পুরস্কার, খেতাব। সহযাত্রী শিল্পীদের সহযোগীতায় গড়েছেন 'চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়',
লোকশিল্পের সংগ্রাহশালা, বাংলাদেশের সংবিধানের অঙ্গসজ্জা। মৃত্যু পরবর্তীকালে তাঁর
আঁকা ছবি দেশের কাগজের মুদ্রা , ডাকটিকিট এবং পাসপোর্টে স্থান পেয়েছে, যা এপার বাংলার
মহান শিল্পীদের কাছেও স্বপ্নস্বরূপ। আপামর দেশবাসী জয়নুল আবেদিনকে ভূষিত করেছেন 'বাংলাদেশের
শিল্পাচার্য' বলে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Excellent
ReplyDelete