Friday, July 31, 2015
আমার সধবা পাড়া
ও পাড়ার অলিগলি গুলোতে বৃষ্টি রাতের একটা অনুরণন রয়েছে। সন্ধেবেলার ক্লান্ত পরিসরে রুটির দোকানে যে গরম আঁচ টুকু পাওয়া যেত তার খানিকটা ধার করে নিয়ে অথবাপয়সা দিয়ে বারোটা রুটি কিনে বাড়ির পথ। কুকুর-খোঁদল আর মানুষে পরিপূর্ণ কয়েকটা এলোমেলো রাস্তা----রিক্সা স্ট্যান্ড, রোল-চাউমিনের দোকান পেরিয়ে যে রাস্তাটা খাল্পারেরদিকে বাঁক নিয়েছে, তার একটু আগেই একটা চারতলা বাড়ির উপরের ঘরে। ওই পাড়ায় শাঁখা-সিন্দুর পরে কেউ কোনদিন দ্যাখেনি। অথচ, বাজার নিয়ে ফেরার পথে, বা ভিজেচুলে মুদির দোকানে সকালের পাউরুটি যে চিনির মত কয়েকটা জিনিস আনার প্রয়োজনে দু-একজন জিজ্ঞেস করত, 'কি গো ভালো, বর ভালো?'
এই মহিলাদের সঙ্গে কখনো কোনো মিল খুঁজে পাওয়ার কোনো আন্তরিক চেষ্টা করা হয়ে ওঠেনি। শিবরাত্রির রাতে বা লক্ষ্মি পুজোর সকালে যাঁরা উপসী পেটে মঙ্গলকামনার ব্রতরাখেন, পাঁচালি পড়ে সতীত্বের কিয়দংশের পরিচিতি জানান দেন পরিবারের বাকিদের, তেমন কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। বরং আরো অনেক বেশি ঝোঁক ছিল প্রগতিশীলতার প্রতি।কোনটা প্রগতিশীল, কোনটা নয়, নিত্যদিন আলোচনা। হাফ প্যান্ট প্রায় দস্তুর বাড়িতে,নাইটি নয়। রোজ রাতে পাশাপাশি শোয়ার চেয়ে পৃথকীকরণ করা নিজেদের 'স্পেস' ইত্যাদি।প্রেম-যৌনতা তো হাহাকারের সঙ্গী। গায়ে গায়ে থাকলে, তার রং ফুটে ওঠে না। তাই-ই সই। নাইবা হলো। অফিস থেকে ফিরে এলে এক কাপ চা, বিটোভেন, মোজার্ট বা সোনাটা।সুমনের গান। হটাত আবিষ্কারে ভালো লেগে যাওয়া কালী দাশগুপ্তর---- চল মিনি অসম যাব। মিনির অসম যাওয়া হয়েছিল কি? উত্তর আসেনি। তবে সেবারের বাড়ি ভাড়ারটাকাটা কন্টিনজেন্সীর টাকায় এসেছিল। সঙ্গে দু বোতল বিয়ার। মুরগির মাংস আর কয়েকটা বেগুন, ফুলকপি। কারণ বাজারে তখন আলুর আকাল।
রান্নার তোড়জোড় চলত বহু রাত ধরেই। বেগুন দিয়ে মাংস রান্নার চেষ্টা বেনুদি ছাড়া আর কোনো সুখী গৃহ কোণে এযাবত্কালে কেউ করেছিল কিনা জানা নেই। তবে ওইবাড়িতে এই ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে চলত সেটা পাড়ার অনকেই জানত। প্রায়শই পাশের ফ্ল্যাট-এর বৌদি জিজ্ঞেস করতেন কাল অনেক রাত পর্যন্ত রান্না করছিলেন বুঝি! মাথানিচু করে জানানো হত, নাহ ওই আর কি! বাইরের খাবার কিনে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি, আমরা । তাই বাড়িতেই দুটো ফুটিয়ে নিই।
ছোটবেলায় বাড়ির সামনে একটা পুকুর ছিল।দোতলার বারান্দা থেকে দেখা যেত একটা পঞ্চায়েতের টিউবয়েল...টগর গাছটার এলানো ডালে হেলান দিলে দেখতে পাওয়া যেত অহোরাত্র মেয়ে বউরা কাঁখে কলসি নিয়ে পুকুর আর টিউবয়েল থেকে জল নিয়ে যায়। মাটির, স্টিলের, অথবা আলুমুনিয়ামের কলসি। বছরের কিছুবিশেষ দিনে পেতলের ঘড়া। কোমরের খাঁজে বসিয়ে শরীরের উপরের অংশ তা একটু কাত করে পেছন দুলিয়ে চলে যেত। উত্সাহবশে প্রশ্ন করলে উত্তর আসত, বড় হলেতোমাকেও শ্বশুরবাড়িতে কাঁখে কলসি নিয়ে জল আনতে যেতে হবে। কিইই স্বপ্নময় শ্বশুরবাড়িটা তাই না! একখানা বর, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি। সময়মতো একটা শিশুও আসবেকোলে। কেমন যেন, গা শিরশির করে। লজ্জা হয়। তবে দিবা-স্বপ্নের দুনিয়াতে তার কি অমোঘ আকর্ষণ।কিন্তু এই নিয়ে কেউ ইয়ার্কি করলে, বুক চিতিয়ে বলা 'দূর আমিকোনদিন শ্বশুরবাড়ি-ই যাব না।' মানে কি? বিয়েই করবি না? এসব কথা আমার ভালো লাগে না বলে দিছি। এসব কোনো সুস্থ মানুষে করে না।
বড় হওয়ার পর কলসি নিয়ে পুকুর থেকে বাড়ির খাবার জল আনতে হয়নি কোনোদিন। কারণ ওটা ড্রামে আসত। তবে কাঁখ শব্দটি পিছু ছাড়ল না। সেবার শহরে হার্বার্ট এসেছে। ফ্যাত্ফ্য়াত সাই সাই শব্দে উড়ছে। সরকারী সিনেমা হলে মাত্র কুড়ি টাকার টিকিট কেটে দেখাও যাচ্ছে। একদিন কলেজ কেটে বন্ধুদের চাট সহ্য করেমেট্রোয় উঠে কোনমতে হাফাতে হাফাতে শো শুরু হওয়ার দশ মিনিট পরে হলে ঢোকা গ্যালো। হার্বার্ট যে এত বড় ডিসকভারি তা কে জানত। ইন্টারভালের পর বোঝাগ্যালো কাঁখ ব্যাপার তা কে আসলে বুঝতে গেলে একটা আস্ত মানুষ লাগে। না হলে সেটা চেনা বা বোঝা যায় না।
ভাঙ্গা তক্তপোষ, স্টিলের আলমারি আর তার গায়ে বসানো সস্তার আয়না, সিগারেটের প্যাকেট। অজস্র বই আর কাগজের বান্ডিল দিয়েই প্রথম সংসারের সূত্রপাত। আধ খানা বালিশে ভাগাভাগি মাথা, সিঙ্গেল বেড কম্বলে আধাআধী ঢাকা এই সব। বাসন কোসন বলতে একটা হাড়ি, দুটো থালা, দুটো গ্লাস, একটা কড়াই আরকয়েকটা প্লাস্টিকের চামচ। জীবন তার গতিতে চলে। চোখাচখি অরাআরী হলেই একটা মৃদু মন্দ বাতাস দিত। প্রতি মাসের শেষে একটা ভয় ছিল। এই এলো বুঝি। না নাআসেনি। এবারের মতে রেহাই দিয়েছে ।
সেবারের জুলাই মাস। ঘন বর্ষায় ইলিশ মাছ আর বন্ধুদের আড্ডা। স্টেশন-এর ধারে কাফীদা দের আড্ডা। সৌম্য, রজক থেকে শুরু করে আরো অনেকে। সিগারেট দু-প্যাকেট কিনে ফিরতেই হবে। তারপর চলবে লুকোচুরির খেলা। কে প্যাকেট তা ভালো লুকোতে পারে? আলমারির মাথায় যার হাত যায়,
সে লাভবান। সকালের জন্য দুটো একটা রেখে দিতেই হবে বলে রোজ অশান্তি, খুনসুটি। রোজ ঝগড়া করলে খুব আরাম হয়। তারপর আর একা শুতে হয় না। আলাদা বিছানা ছেড়ে কম্পুটারের ঘরের মেঝেতেই একসাথে শুয়ে পড়া। নতুবা ভোর রাতে বেরিয়ে চার নম্বরের নেপালদার চা-ঘুগনি। তার সঙ্গে একলাঙ্গী ঘরার বেহাগ। দিব্বি দিব্বি।
দিব্যি দিয়ে বলছি,
এমনটা আর কখনো করব না। পড়তে বসলে কোনদিন জ্বালাব না। সাব মিশন-এর আগের রাতে বিরক্ত করব না। মাটিতে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসব না। অকারণ সন্দেহে মোবাইল কোনদিন ঘাটিনি। মেসেজ করতে গিয়েই তো চোখে পড়ে গ্যালো। দিব্যি করে বলছি আর বাড়িতে ফিরে ফোন ধরব না। অফিস এর হলেও না। প্রয়োজনে চাকরি, তাই ছেড়ে দেব। তাহলে খাব কি? সেটা পড়ে দেখা যাবে। আপাতত চলুক। কিন্তু একা ঘুমোতে বোলো না। ওটা অনেকদিন হলো আর পারি না। একসঙ্গে শুয়ে তোর ভালো ঘুম হয় না বল? হয় তো, 'ভালি ভালো হয়', মুখ ভেঙচি কেটে বলে চলে গ্যালো।
তারপর?... তারপর শুরু হলো এক ইদুরের কাহিনী। কাকেদের তাড়া খেয়ে এক ইদুর ঢুকে পড়ে কপোত-কপোতীর বাসায়। ঘরে তার ঠাই নেই। অগত্যা বাথরুম এ। জল যাওয়ার গর্তে সে জলের সঙ্গেই জমে থাকে। সেই বাথরুম এ পদচারণার শব্দ পেলেই ফোস ফোস করে তেড়ে আসে। বুক ঠুকে দুজনকেই তাড়িয়ে ছাড়ে।এই নিয়ে গোলমাল লাগে। কে ওই অতিথিকে নিমন্ত্রণ করেছে? কপোত জানায়, সে করেনি। কিন্তু তার বউ নাছোড়। না। তাহলে কে?
কপোত রাগে বাসা ছেড়ে চলে গ্যালো। কপোতী নিরুপায়, কেন কে জানে?
সংসার নাকি অফিস-এর টানে?
পাশের বাড়ির বাথরুম দিয়ে কিছুদিন কাজ চালিয়ে নিয়ে শেষে ফোন করে খবর দিল বাবাজীবন এবারের মত ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন। অতএব ফিরে আসা যেতেই পারে।
পাল্টা বায়না কাঁধে নিয়েই ফিরে আসা। চিঠি এলো। 'লিখিও উহা ফিরত চাহো কিনা'। ফিরত নাকি ফেরা?
তা নিয়ে তাত্ত্বিক কচকচি চলল। এখনো চলছে। বাসায় ফেরা নাকি মনে?
জানি না.....সেগুলো হয়ত ফেরার পর জানা যাবে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment