Friday, July 31, 2015
মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়
(কাব্যগ্রন্থ- নক্ষত্র পুরুষ‘’, ‘জ্যোৎস্নার নাবিক’ , ‘
প্রতিবাদী সময়ের মুখ’, ‘
অর্জুনের চোখ’, ‘ শস্যের
মলাট’ ,’ বুকের গোপনে অস্ত্রগুলি’ , ‘ অবাক
পৃথিবী’, ‘আমি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বলছি’, ‘ সেই
মানুষ’, ‘ কাচঘরে আগুন’, ‘ মাড়
ভাতের লড়াই’ ,’ চাঁদে
এককাঠা জমি’ , ‘ মাঠ
খসড়া’ , ‘ রক্তের উজান ঠেলে’ , ‘ কাঞ্চন
শস্যের বীক্ষা’ ‘ সময় ও
সূর্যের কাছে’, ‘মেধাবী
নীলিমা’, ‘সেই আগুনের বিষুবরেখায়’ ......)
একজন
কবির মূল্যায়ন কে করতে পারে? সমকাল!
মহাকাল! পাঠক! প্রতিষ্ঠান! পুরষ্কার! নাকি কবিতা নিজেই? কবিতা নিজেই হয়ে উঠতে পারে
নিজের উপস্থিতি নিজের বিস্ময় ! কবি এবং
কবিতার ক্ষেত্রে এজাতীয় গ্রহণ বর্জন স্বীকৃতি অস্বীকৃতির প্রশ্নে ভাঁটা পড়ে না চিরকালেই
কিন্তু অগ্রজ কবি মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় যখন তাঁর ছ দশকের সৃজন আর শব্দের
দীর্ঘকালীন চরাই উতরাইয়ের শেষে আজও বলেন-‘অনেক তরুণ কবি আজও কবিতা পড়ে মুগ্ধতা জানায়, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হয়না’ তখন সত্যি মনে হয় আজও হয়ত
কবিতাই কেবল কবিতার শুদ্ধতম সংজ্ঞা হতে পারে। কবিজন্ম যে চিরপ্রবহমান,অশেষ,তার
বিলীন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মোহিনীমোহনকে লিটিল ম্যাগাজিনের একছত্র কবি বললে অত্যুক্তি
হয়না অথচ এভাবে ছোটো বড় মাঝারি কোনো কবিতাপত্রিকার মাপেও তাকে আবার বেঁধে ফেলাও
যায়না কারণ তাঁর মনন তাঁর শৈল্পিক চেতনা ব্যক্তিগত স্বপ্ন পেরিয়ে সমষ্টিগত
স্বপ্নের প্রশ্রয়ে সৃষ্টির ক্যানভাসে বাসা বেঁধেছে মানুষের মহার্ঘ্যতা মেনে নিয়ে।এখন
পর্যন্ত মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের যে দুটি পরিচয় তাঁর সব পরিচয়কেই নতুন এক মাত্রা
দিয়েছে তা হল এক তাঁর কবিতার বৈচিত্র্য আর দুই দীর্ঘ কয়েক দশকের বাংলা কবিতায় তাঁর
সমাজসচেতন সত্যবত্তা কবিতার তর্কাতীত উৎকর্ষতা। যে দার্শনিকতা তাঁর কাব্যের উপকরণ
হয়ে উঠেছে তারও দায়ভাগে রয়েছে মানুষের ছায়া। একদিকে যেমন প্রেম মানবিকতা তাঁর
কবিতার কন্ঠস্বর হয়ে উঠেছে তেমনি অন্যদিকে শব্দ দিয়ে তিনি বিপ্লবের প্রস্তুতিই
জানিয়ে দিয়েছেন , এই বিপ্লব শ্রেনী সংগ্রামে বিপন্ন নিরন্ন মানুষের বিপ্ল্বব। কেবল
মোহিনীমায়াতেই তাঁর কবিতা জারিত নয় বরং সেখানে কবির দু হাত থেকে ডালভাতের গন্ধ পাই
আমরা, নিকোনো উঠোন থেকে অনায়াসে কবিকে উঠে যেতে দেখি বারুদের ভাঙা স্তুপে। তাঁর
চেতনায় তাঁর অনুভাবনায় কোনো জৈবিক ইতিহাস লুকোতে দেখিনা কবিকে, দেখিনা কোনো
উপনিষদীয় আনুগত্যের কাছে নৈর্ব্যক্তিক চৈতন্য নিয়ে বসে থাকতে বরং একজন কবি যিনি
আদতে স্থুল আর সুক্ষ অভিজ্ঞতায় মাখামাখি একটা মানুষ তিনিই যেন বারবার ভাঙনের মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেছে তাঁর কবিতায়।মানুষের
হাতে মানুষের ভালোবাসা তুলে দিতে জীবনের গান বেঁধে দিতে তিনি যেন নিজের কাছেই
আজন্ম ঋনী হয়ে আছেন আর খুঁজে চলেছেন সেই মানুষটিকে- “ রক্তের পিছল পথে আগুনে
ভিজিয়ে পা/ যে মানুষ হেঁটে গেছে/ যেখানে জীবন আছে যেখানে লড়াই আছে “- সেই মানুষকেই খুঁজতে
ব্যস্ত মোহিনীমোহন। তাঁর স্বপ্নচেতনায় তাঁর শিল্পবিন্যাসে তাঁর পর্যায়ক্রমিক
পর্যবেক্ষনে তিনি যেন সেই মানুষটিকেই বারবার স্বপ্নে ফিরিয়ে এনেছেন যে আজও ধারালো
ছুরির ডগে দু পা রেখে বেঁচে থাকে জীবনের স্বপ্ন দেখে।
কিন্তু এই স্বপ্ন দেখার শুরু আজ
নয়। সাধারন মানুষের বাঁচার লড়াইয়ের সাথী হওয়া কিংবা শেকড়হীন মানুষগুলির সর্বনামের
সাথে হেঁটে যাওয়ার শুরু আজ নয়; একটা সময় তিনিও প্রতীকের ধ্যানে মগ্ন থাকতেন একটা
সময় তিনিও হতে চেয়েছিলেন “জ্যোৎস্নার নাবিক”- একটা সময় তাঁর কবিতা আমাদের শুনিয়েছে বিসর্গিত আবেগ আর আবেশময় রোমান্টিকতার
পংক্তি। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা ,এই গ্রাম বাংলার দুঃখ দ্রারিদ্য ব্যক্তিগত স্বরবর্ণ
থেকে তাঁর কবিতাকে সরিয়ে আনে সামষ্টিক ব্যঞ্জনবর্ণের ক্রোধ আঁকতে। তাঁর কবিতায় এই
বিরোধ এই বিচ্যুতি এক নতুন কালখন্ডের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। এক আপোষহীন
ব্যক্তিসত্বা ব্যক্তিগত প্রতিবেদন পেরিয়ে মোহিনীমোহনকে গড়ে তোলে প্রকৃত চারণ কবি
হিসেবে, যিনি মানুষ খুঁজে গেছেন ভাঙাঘর কিংবা শূন্য মাঠে, দখলি জমিতে কিংবা
চোরাবালিতে- তারা সব জল কাদার গন্ধ মাখা স্বপ্ন খোঁজার মানুষ, টুসু ভাদু ঝুমুরের
সুরে ভাত ঘরের ঠিকানাটা খুঁজে পেতে চাওয়ার মানুষ।
“যারা সমাজ বিরোধী হতে পারবেন না , যারা বোমা বানাতে পারবেন না কবিতা না লিখে
তারা যাবে কোথায়!“- এমনটা বলেছিলেন জয় গোস্বামী। সত্যিই তো কোথায় যাবে গরীব ক্ষেত মজুর কুলী
কামিনের ভাষাগুলো! এই ধূলিমলিন পৃথিবীর প্রান্তিক অন্ত্যজ চিন্তনগুলো, নিম্নবর্গের
চেতনার বয়ানগুলো প্রথাগত সাহিত্যের ইতিহাসে কোথায় তাদের প্রতিস্পর্ধী ন্যারেটিভ
পাবে? তাই তো কবিকে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সমাজের জড়কে ভেঙে দিতে হয় শব্দের হাতুড়ি
দিয়ে। তাই তো উচ্চর্বগীয় বাজার নিয়ন্ত্রিত আধিপত্যমূলক সাহিত্যের নিচে চাপা পড়্রে
যাওয়া বিচ্ছিন্ন পরাধীন নিম্নবর্গের বিরাট মানচিত্র দখল করতে কবি গর্জে ওঠেন,
ছিঁড়ে ফেলেন সাহিত্যের যাবতীয় জারি করা ফতোয়া। তাই তো মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়কে
আমরা মূর্ত জগতের ওপর বেড়ে ওঠা তাঁর কবিতার স্বপক্ষে বলতে শুনি-“গরীব ক্ষেত মজুরের ভাষায়
কবিতা লিখে আমি সেই কবিতাকে পৌঁছে দিতে চাই ক্ষেতে খামারে মাঠে ময়দানে কলকারখানায়
গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে। মানুষকে সজাগ সচেতন সর্বোপরি শোষন মুক্তির জন্যে
সংগ্রামে সামিল ও উদ্বুদ্ধ করতে চাই। আমি খুশি যখন দেখি গরীব মেহনতী মানুষের ঘরে
ঘরে আমার কবিতা পৌঁছে গিয়ে তাদের চৈতন্যে নাড়া দিচ্ছে এবং শ্রেনী সংগ্রামের পথে
ঐকবদ্ধ্য ভাবে তারা লড়াই করছে দুর্ম্মদ প্রত্যাশায়।“- আসলে কবিতার গ্র্যান্ড
ন্যারেটিভ ভেঙে কিংবা কবিতার সেই শুদ্ধ অতিজ্ঞাপনের জগত ভেঙ্গে মোহিনীমোহন ঢুকে
পড়তে চেয়েছেন পুরুলিয়া বাঁকুড়া মানভূম আদরা চক্রধরপুরের অন্তর ভাষায়, সেই বুধন
সদ্দারদের ভাষায় যাদের পিঠে চাবুকের দাগ আর হাতে অশ্রুপতনের ইতিহাস। নাগরিক
বুদ্ধিজীবিতার বাইরে গ্রামবাংলার বিশেষ করে পশ্চিমরাঢের এই কাঁকর মেশানো ভাত খাওয়া
মানুষগুলোর ভাষাই হয়ে উঠেছে মোহিনীমোহনের নতুন কাব্যদর্শন। এই উপেক্ষিতদের খুঁজতে
খুঁজতেই তিনি লিখেছেন-
“ সত্যিকারের
একটা মানুষ আঁকতে হবে
দুঃখে ভেজা চোখের জলে/
কিংবা বুকের আগুন দিয়ে
আমি জানি এটাই শিল্প
এটাই কাব্য
এ জন্য চাই সন্ধিবিহীন
একটা লড়াই”-
শ্রেনীবিভক্ত এই সমাজে
শ্রেনীহীনদের নতুন ডিসর্কোস গড়ে তোলার কাজ মোহিনীমোহন সেই মানভূমের ভাষা আন্দোলনে
সময় থেকেই অনুভব করেন। বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের ওপর চলছে তখন নির্মম অত্যাচার আর
সারা পুরুলিয়া উত্তাল বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য। টুসু গানে ধ্বনিত হচ্ছে
তখন –“ শুন বিহারী ভাই/ তুরা রাইখতে লারবি জাং দেখাই” র মত পংক্তিরা; ভাষা আন্দোলনে
সক্রিয় যোগদান না থাকলেও ভাষা আন্দোলন কোথাও যেন মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়কে চিনিয়ে
দিয়েছিল তাঁর বাকি কবিতা জীবনের ধর্মটিকে। যেখান থেকে কবিতায় প্রেম বিরহ আনন্দ
যন্ত্রনার বাইরে তিনি কবির সামজিক দায়ভার নিতে এগিয়ে আসেন। তাঁর চিন্তা চেতনায়
অগ্রনী ভূমিকা নেয় শ্রেনীবিভক্ত সমাজের কথা। না ,কোনো বিপ্ল্বব বা আন্দোলনের শরিক
ছিলেন না মোহিনীমোহন, তবে মার্কসবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে,
যার জন্য তাঁর জীবন বিপন্ন হয়েছে বহুবার ,বহুবার তাঁর কবিতাকে তকমা পেতে হয়েছে
স্লোগানসর্বস্ব নামে, আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতার মধ্যে দিয়ে প্রান্তিক শ্রেনীকে
রাষ্ট্রবিদ্রোহী করে তোলার মত যুক্তির কাঠগড়াতেও তোল হয়েছে তাঁকে , কিন্তু বারবার
তিনি ঘোষনা করেছেন কবির কোমরে কোনো শেকল নেই গলায় নেই দড়ির দাগ, বারবার তার প্রতিবাদ নিয়ে পংক্তি নিয়ে হাজির হয়েছেন ,
হাজির হয়েছেন ‘লফরা মাহাতোর জবান বন্দী’ নিয়ে, ‘দু বিঘা জমির উপেন’ কে নিয়ে। ভাষা আন্দোলনের
প্রান্তিকবহ্নি মেহনতী মানুষের মন বুঝতে সাহায্য করেছিল মোহিনীমোহনকে। অনুভব করতে
সাহায্য করেছিল –“গ্রাম মানে কিছু গাছ গাছালি/একটা নদী একটা বন/কিছু লাল মাটি
আর/গোবর মাখা বাড়িঘর নয়/গ্রাম মানে/ ইস্পাত তাতানো উত্তাপ”—এই উত্তাপই হয়ে
উঠেছে মোহিনীমোহনের পরবর্তী কবিতার নতুন পান্ডুলিপি। যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি প্রতিবাদ
করতে শিখিয়েছেন পাঠককে শিখিয়েছেন খেটে খাওয়া শোষিত মানুষগুলোকে। এই উজ্জ্বল গনগনে
ভাষারই সুর শুনি আমরা “ লফরা মাহাতর জবান বন্দী’তে –
“যারা আমাকে মিছা মামলায় জেলে ঢুকাল্য
যারা আমার বউটোকে ছেল্যাটোকে ভখে
মাইরল্য
যারা আমার ভিটামাটিতে বেনাহক ঘু
ঘু চরাল্য
তারাকে তামাম দুনিয়া থাহিকে শিকড়
বাকড় সুদ্ধা
উখড়াই ফেইলব
আছড়াই মাইরব চাট্টান পাথরে।......”
‘মাড় ভাতের লড়াই’, ‘ রক্তের উজান ঠেলে’ কিংবা ‘ সেই আগুনের বিষুবরেখায়”-র মত কাব্যগ্রন্থের একের পর
এক কবিতায় কেবল প্রতিবাদের ভাষাই নয় বরং তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের মধ্যে দিয়ে
আঞ্চলিক ভাষার অনন্য সম্ভার তুলে দিয়েছেন
মোহিনীমোহন। যা একজন কবির স্বতন্ত্র সাহিত্যপাঠের সাথে সাথে সামাজিক চেতনারই
প্রতিফলন বলা যায়। কবির সামাজিক দায়বদ্ধতার
প্রসঙ্গে ‘অক্সিজেন’-র সম্পাদক সুর্বণ রায়ের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে
মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন- “ যেহুতু আমি সমাজে বাস করি সেই জন্য আমাকে সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতাকে স্মরনে রেখেই কবিতা নির্মাণ করতে হয়। আমার মনের মধ্যে যে
কোন ভাবনাই উৎসারিত হোক না কেন আমাকে কবিতা সৃষ্টির সময় চিন্তা করতে হয় কি লিখব?
কেন লিখব? কাদের জন্য লিখব? কবির উপর সারা ভুবনের ভার নেই, কিংবা একজন কবি সমাজ
বিপ্ল্ববী ও না। কোনো কবি সমাজ বিপ্ল্বব সংগঠিত করতে পারেন না। সে কাজ বিপ্লবী
রাজনৈতিক দলের। কিন্তু একজন কবি যেহুতু সর্বদা সংবেদনশীল, সমাজসচেতন এবং সমাজে
অগ্রনী ভূমিকার সফল অংশীদার সেইজন্য তাঁকে শ্রেনীবিভক্ত সমাজের কথা ভাবতেই হয়।
কবিতাতেও সেই ভাবনাগুলি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।“তাঁর আঞ্চলিক কবিতায় মূলত পুরুলিয়ার লোকজীবন
বিশেষভাবে উঠে এসেছে, সেখানকার পাথর ভাঙার শব্দ, সেখানকার ঘামে ভেজা পুরোনো দিন,
সেখানকার প্রতিদিনের জন্ম পুড়িয়ে মৃত্যু পুড়িয়ে স্বপ্ন পুড়িয়ে রুখা মাটির
মানুষগুলোর কথা তাদের খিদের কথা তাদের পালটে যাওয়া সময়ের কথা আর এইসব শোষিত
মানুষের ওপর সমাজের ভয়ংকর আঁচড় কামড় আর হাততালিগুলোর কথাই বারবার উঠে এসেছে
মোহিনীমোহনের শিরদাঁড়াওয়ালা কবিতাগুলোতে। ‘রানার’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী বিজয় কুমার দাস কবি
মোহিনীমোহনের আঞ্চলিক কবিতাগুলি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেগুলিকে কেবল আঞ্চলিক কবিতার
তকমামুক্ত করে জীবনের অবিকল ছবি বলেছেন। মদনা কাহার, ছিদাম বাগদী কিংবা শঙ্কর্যা
বাউরী চরিত্ররা আসলে কিছু সীমাহীন মানুষের প্রতিবাদী মুখ, এরা পুরুলিয়া বা
মানভূমির বৃত্ত পেরিয়ে আসলে এই বিশ্বপৃথিবীরই ভেঙে পড়া নিম্নবর্গীয় চেতনার
প্রতিসর্ন্দভ। জীবনের এই আকরিক এই খনিজগুলোই ঘেঁটে মোহিনীমোহন তুলে এনেছেন “আপামর নিরক্ষর মানুষের
চেতনার মন্ত্র”- তা আঞ্চলিক হয়েও আঞ্চলিকতায় সীমাবদ্ধ নয়। সেখানে গভীরভাবে
ছড়িয়ে রয়েছে এক নগ্ন বাস্তবতা। পুরুলিয়ার ছৌ নাচ আর ছৌ শিল্পীদের নিয়ে
মোহিনীমোহনের কবিতার উদাহরণ টেনে শ্রী দাস জানাচ্ছেন এ কবিতা আসলে চূড়ান্ত উপেক্ষার ইস্তেহার,
মেহনতী মানুষের রোজকার দিনলিপি। যেখানে মোহিনীমোহন অনায়াসে লেখেন-
“ ভাঙা ফুটা ঘরে জল ঝরছো ত ঝরছোই-
চালা বাঁধার পুয়াল নাই
গহাল্যে গরু কাড়া নাই
ধানের পাইল চালের কুচুড়ি কথায়
পাবেন?
রগদাঁই রগদাঁই তাড়াই মাইরছে খিদা
তিষ্টা
আঁতুড়ি ভূতূড়ি গুল্যাব ব্যারাই
গেল
কিন্তুক লাচ থামছ্যে নাইখ
লাচের সংগে ব্যাঁধে লিয়েছে মনটাকো
!......”
আসলে এই হেরে যাওয়া ভাঙা ফুটো মানুষগুলোকে নিজের হাড়
দিয়ে বেঁধে নিয়েছেন মোহিনীমোহন আর নিজেই আর একটি নিয়ম ভাঙার গান খুঁজছেন কয়েক দশক
ধরে, যে গানে ক্ষুধা তৃষ্ণা থমকে দাঁড়াবে, যে গানে বৃষ্টিতে বিদ্যুতে ফেন ভাতের
চুল্লীর গন্ধেতে নিবিড় উত্তাপ নেবে মধ্যবিত্ত মন, যে গানে সহস্র বুলেট ফুটো
হৃদপিন্ড নিয়েও মানুষগুলো একদিন না একদিন সবুজ জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে দেবে। মোহিনীমোহনের
কবিতা কোথাও যেন জীবনের কবিতা, কোনো ভনিতা নেই ভারি দার্শনিকতা নেই ছদ্মবেশ নেই –যেন খুব হালকা , নিষ্কলুষ
সারল্যে ভরপুর, তাঁর কবিতার ঘরে গরীব গুরবো মানুষ, নিরাভরণ শুকনো নারী আর ল্যাংটো
খোকার ভীড়, লতায় পাতায় জড়িয়ে রয়েছে তাঁর স্বদেশ , তাঁর অযোধ্যা পাহাড়, একবুক খিদে
নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ডুংরি পাথর ; একেবারে মানুষের মুখের ভাষার কবিতা নিয়ে দীর্ঘদিন
কাব্যসাধনায় রত মোহিনীমোহন।
একদিকে যেমন তিনি প্রতিবাদী যা
তাঁকে আঙ্গুল তুলতে শিখিয়েছিল কবিতার ভেতর দিয়ে, প্রানের দোসর হতে শিখিয়েছিল
মানুষের তেমনি কোনো বাঁধাধরা ছকে নিজের কবিতাকে আবৃত করে ফেলেননি মোহিনীমোহন
গঙ্গোপাধ্যায়। অসংখ্য কবিতা এবং দীর্ঘ
যাপনব্যাপী কবিতার সাধনায় আত্মসমর্পিত প্রাণ মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, কবিতাই তাঁর
প্রাণ ,মোহিনীমোহনের জীবনই যেন তাঁর কবিতা। কিংশুকের আগামী সংখ্যায় প্রকাশিতব্য এক
সাক্ষাৎকারে কবি মোহিনীমোহন নিজের কবিতা প্রসংগে বলেন-“কবিতা কী এক কথায় তা কি বলা
যায়? না কি বলা সম্ভব? মানুষের শুদ্ধতম চেতনার ঋদ্ধ ফসল হচ্ছে কবিতা। কবিতা হৃদয়ের
শৈল্পিক প্রকাশ। গভীর জীবন বোধ আর মননশীলতার তলদেহ থেকে উঠে আসে এই আকরিক। সময়ের
সূতিকাগারে জন্ম নেয়া এক একটি কবিতা আসলে প্রজ্ঞা ও বোধির ঐশ্বর্যে ঋদ্ধ সুন্দর
অফুরান প্রাণের বিজয়বার্তা”- কবিতার এই নতুন সংজ্ঞার কাছে এসে সেই পরিচিত মোহিনীমোহনকে
যেন কিছুটা অচেনা লাগে; যেন বিপ্ল্ববের প্রয়োজনীয়তা থেকে কিছুটা থিতু হয়ে প্রতিবাদের
ব্যাকরণ থেকে কিছুটা পিছিয়ে এসে শতাব্দীর
অতন্দ্র এক চারণ ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছেন। যেন এতখানি পরিক্রমণের শেষেও একজন
দ্রষ্টা তাঁর পথিকসত্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, প্রসরণ খুঁজছেন আরও প্রানের , প্রবাহের
মধ্যে , এতগুলো বছর সাহিত্যচর্চার শেষে এসে আজও যেন বলছেন-“ কোথায় আমার যাবার ছিল আমার
কিন্তু যাওয়া হলো না../কি যেন সব বলার ছিল কিছুই আমার বলা হলো না”...এই আকুতি এই ভুখ আসলে
কবির নিজের , নিজেকে পাওয়ার খিদে., বিপন্ন সময়ের মাঝে তিনি যে বিপ্লবের প্রস্তুতি
লিখেছিলেন তাঁর কবিতার মেধাবী নিলীমায় , যে অনিবার্য কালচেতনা তাঁকে প্রভাবিত
করেছিল এই গ্রহের কান্না মুছে দিয়ে এক একটি সুসংবদ্ধ উজ্জ্বল সনেটের মত জীবন খুঁজে পেতে সেই কবির পথ
যে সীমাহীন , তার চলার যে শেষ নেই, আজও কারা যেন পেছন থেকে তাঁকে টান দেয় বারেবারে
আর কবি বলে ওঠেন-
“যতবার এগিয়ে যাই ততবার পিছনে কে টানে?
এ টানের কোনো কিছু অর্থ বুঝি না
চলতে জানাটাই একটা কঠিন জীবন
সমস্ত নিয়ম ভেঙে চলতে গেলে সজোরে
পিছনে পড়ে টান ।
আসলে তাঁর কবিতা আর জীবন কোথাও
একসূত্রে গাঁথা; বিগত ষাট বছর ধরে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে বসে তিনি যে নিরন্তর
শিল্পসাধনা করে গেছেন, প্রতিষ্ঠানের কাছে আত্মসমর্পণ না করে মানুষের মনের কথা বলতে
যুগের যন্ত্রনার কথা বলতে সম্পূর্ণ জেনে বুঝে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক লিটিল ম্যাগাজিনের
কবি হতে চেয়েছেন সে কবিতা আসলে মানুষের ঘামে রক্তে হেসে ওঠা কবিতা, সে শিল্প আসলে
ভূমি সংলগ্ন একটা লড়াই, মাটির কাছাকাছি হতে চেয়েছেন মোহিনীমোহন , শব্দের ছিলা
ছিঁড়ে বেরিয়ে পরা সময়াতিক্রমী এক অনুসন্ধানই হয়ে উঠেছে মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের
আইডেনটিটি।তাঁর কবিতা সম্পর্ক প্রখ্যাত কবি কৃষ্ণধরের মূল্যায়নটিই হয়ত যথাযথ হবে
এক্ষেত্রে-“ কবিতা কোন তুক তাক মন্ত্র নয়। মানুষের অস্তিত্বের গূঢ় কথা
তাতে ভাষা পায়। কখনো সে স্বপ্ন দেখে, কখনো সবকিছু তছনছ করে দিয়ে মনুষ্যত্বের হাত
ধরে এগোয় ভোরের দিকে। মোহিনীমোহনের কবিতায় তারই প্রতিফলন। তিনি বাংলা কবিতার জগতে
যে সংগ্রামী শুদ্ধতার দৃষ্টান্ত রেখেছেন তা দীর্ধকাল সঠিক ও অনুরাগীদের মনে সাহস ও
সান্ত্বনা জোগাবে...”।
তিনি কবিতার এক অক্লান্ত স্রষ্টা।
কত কত যে কবিতা লিখেছেন সেসব গ্রন্থিত অগ্রন্থিত কবিতাদের কোনো একটি সংখ্যায় রাখা
হয়ত সম্ভবই নয় । সমতট, জিগীষা, কবিতাপত্র, উত্তরসূরী, জিজ্ঞাসা, গঙ্গোত্রী, অনীক,
মহাপৃথিবী, ধ্রুপদীর মত অগুন্তি অসংখ্য ছোট পত্রিকায় লিখেছেন মোহিনীমোহন। নিরলস
কাব্যচর্চা করে গেছেন পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত শিয়ালডাঙায় বসে , প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে সম্পাদনা
করে গেছেন তাঁরই কবিতার কাগজ ‘কেতকী; প্রতিবাদী কবিতা বলে তাঁর কবিতাকে কখনও সখনও সরলীকরনের চেষ্টা করা হলেও এবং নিজে
সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও রঙিন পালকে ঢাকা রাজনীতি তাঁর চোখ ধাঁধায়নি; জীবনব্যাপী তাঁর নিষ্ঠা ত্যাগ একটি মুক্ত
মানুষের একটি মুক্ত কবিতার প্রতি, যা স্বাধীন ও সর্বত্র্যগামী। আত্মাকে বিক্রি
করেননি তিনি আধিপত্যের কাছে বরং আকাশ বাতাসের হাত ধরাধরি করে কবি মোহিনীমোহন
গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতারা ফিরে ফিরে এসেছে একটি সহজ সাধারন মানুষের ধুলোভর্তি পায়ের
কাছে , রেখে গেছে মননের একটি বিনীত প্রণাম......
নির্মাণ
আমার সব গল্পের এখন শুরু কোন
গল্পই শেষ হয় না।
গল্পের শুরুতেই রহস্য ও রোমান্স
থাকে
শেষ হলে কিছুই থাকে না।
দুঃখের ভিতরেও বিস্ময় ও আনন্দ আছে
আছে বলেই তো যত গল্পের শুরু ।
গল্প শুনতে শুনতে ফুটলো টগর হেসে
উঠলো মল্লিকা-মালতী
সন্ধ্যার রজনীগন্ধা হ্যান্ডসেক
করে গেলো।
ওগো রাত্রির চাঁদ তোমার
জ্যোৎস্নায় কতো ভালোবাসা
আমি জেনে গেছি।
ওগো মধ্যাহ্নের সূর্য তোমার খর
উত্তাপে রোদ্দুরের চুম্বন
আমাকে রোমাঞ্চিত করে।
আমি জ্যোৎস্নায় রোদ্দুরে দৌড়ুতে
দৌড়ুতে কোথায় যাচ্ছি
নিজেই জানি না।
আমার জানা না-জানার গল্পগুলো ডানা
মেলেছে ।
মাটি ফাটছে পাথর ভাঙছে
আর আমি ভূমিকম্পের উপর দাঁড়িয়ে এক
আশ্চর্য মানুষ
নিজেকে ভাঙছি গড়ছি তৈরী করছি
নতুনভাবে ।
তোমরা আমার গল্প শুনে কেউ বিস্মিত
হয়ো না
এই তো তার সবেমাত্র শুরু ।
ছায়াসঙ্গী
আমার ছায়ার সঙ্গে সারাদিন ঘুরে
ফিরে বাড়ি ফিরতাম ...
প্রতিদিন রাস্তার মোড়ে আড্ডা দিই
চা দোকানে চা খাই বিড়ি টানি
রাজনীতির গল্প বলি স্ফূর্তি উড়াই
ছায়া শোনে চুপচাপ পাশেই দাঁড়িয়ে
থাকে
সব কিছু দেখে শুনে মুখ ফুটে কিছুই
বলে না ।
ছায়ার কি ভয়ডর আছে? কিছুই গোপণ
নেই গোপণ থাকে না
আমি ও আমার ছায়া পাশাপাশি
সমান্তরাল
আমার প্রেমিকা জানে তাই কোন
চোখমুখে লাজলজ্জা নেই
প্রাণ খুলে কথাবার্তা হয়।
আমি ও আমার ছায়া একসঙ্গে থাকলেও
দুজনের মধ্যে কোন বন্ধুত্ব হলো না
ছায়া সে ছায়ার মত, আমিও আমার মত
আছি
প্রতিবিম্বে দোল খায় ফুটে থাকা
ফুল ।
প্রতিদিন প্রতিটি মূহুর্ত যায়
ছায়া দেখে আমার মধ্যে শুরু
ক্রমাগত যুদ্ধ তুমুল ।
মাড় ভাতের লড়াই
হাই নদীর ধারে ট্যাঁড় বাইদের জমি
ট তে ইবার বড় ধান জন্মেছো ব ।
সোনার বন্ন ধান ভ্যালে দেইখলে চোখ
থির্যায়
ডাকলো রা ক্যাড়ে, মাথা নুয়ায় ।
ইঁয়া গাছা গাছা ডাগর ডাগর শীষ
গিল্যান
হাওয়ায় লড়ছো আর শুনা যাছো
হাজার কিসিমের আওয়াজ-গজল গান ।
বলি তুমরা আওয়াজটা শ্যুনছ হে?
পানু বান্দির জমি ছিল ইটো ;
এক কুড়ি দু বছর আগে মিছা দেনার
লেখ্যাই লিয়েছিল
গাঁয়ের মড়ল দিগম্বর বাড়ুজ্যার
লাতি ।
বাড়ুজ্জ্যার বড়া দাপট ছিল হে
এক ঘাটে বাঘে বলদে জ ল খাত্য
হাঁকলো পরে লাল পাগড়ি পুলিশ আসত্য
লাঠি পিটা করতা হাঁড়ি বাগদি বাউরী
গিল্যানকে
আর বাড়ুজ্জার লাতি চিয়ারে বস্যে
ঠ্যাং এর উপরে ঠ্যাং ল্যাচায়ে
বলত্য-
“দ্যাখ শালারা ক্যামন মজা
ছুটু লক ছুটু লকের পারা থ্যাকবি
উপরে উঠবি ত ইমনি চাবুক চলব্যেক
গাঁচ ছাড়া করব্য সবকাইকে।“
ইমনি কর হামদের গরীব লল গিল্যার
শুধু জমি লয় আইজ্ঞা
ঘর বাড়ি ছাগল ভেঁড়ি মোয়ালকের
ইজ্জত লিতে লাইগল
মাছে ঘি ল্যেশে ভুটরা গতর লড়াই
লড়াই
বাগান বাড়িতে ফুরফ্যুরা হাওয়া
খাত্য ।
পানু বাগদিকে ঘর ছাড়া কর্যে
বাবুর কি ফুরতি-
সব্বাইকে শ্যুনাই শ্যুনাই বলত্য-
“চ্যাং মাছের পারা কেও লাফাবি ত ঠ্যাং ট ট্যুঁনাই দিব ।
পোনার পারা গাঁ ছাড়াব
বড় ব্যাড় ব্যাড়েছিল শালা
বেগার খাটত্যে ধমক লাগত্য
লুক্যাঁই লুক্যাঁই কৃষক সভা করত্য
মিটিনে মিছিলে যাত্য
লে শালা সামাল ঠোলা
পিঁপড়া হাঁয়ে হাতির সঁগে বাদ
বাগদির ছা ইখন ভাঙা ফুটা টিনের
সানকি লিয়ে
ই গাঁয়ে উ গাঁয়ে দুয়ারে দুয়ারে
মাগো খাছ্যে
চাল সিঝা আর মাড় ভাত ।“
খিদা তিষ্ঠায় ভখে শুক্যাঁই আমসি
হ্যঁয়ে মর্যে বাঁচলা পানু বাগদি।
সাত কুলে কেও নাই
খালি বাতাসে মিশে রইল্য বুক ফাটা
কান্না
হাড় ফাট্যাঁই ব্যারায় আসা
দীর্ঘশ্বাস ।
হাই লদীর ধারে ট্যাঁড় বাইদের
জমিটোতে ইখন জমিদার বাবুর
চাবুকের দাগ পানু বাগদির হাই
নিঃশ্বাস আর
কান্না লাগ্যে আছে হে ।
উ জমি টো ইখন আমার ।
আমি বুদ্ধি ভাঁওর কর্যে লিজের
হাতে চাষ আবাদ ক্যরেছি ।
বড় ধান জন্মেছ্যে ব, সোনার বন্ন
ধান
ভাল্যে দেইখলে বুকটো সুর সুরায়
চ্যখ দুটো থির্যাই যায়
ধানশীষ গিল্যান হাত সান দেই ।
আচকা মন্ত্রী বদলের সঁগে সঁগেই ই
বাঙলাতে শুরু হ্যঁয়ে গেল লইতুন আইন
লুক্যাঁই রাখা বাড়তি জমির হিসাব;
বেনামী জমি কাড়্যাই লিয়ে গরীব লক
গিলার হাত দিয়ে দিলেক
জমি আর দলিল পাট্টা ।
পানু বাগদির সি জমিটো বাড়ুজ্জার
খ্যাপর থ্যাকে
চল্যে আল্য হামার হাতেই,
আর সি থ্যাকে কি ভজ-অ কট-অ বাপ ।
উয়ারা বলল্য “বেটা ঝমর্যে যাছিল্য ভখে
ইখন জমি প্যাইয়ে ভগা পিঁধার মুনে
লাচছ্যে ঘুর ঘুর্যাটি,
আছুলা একেই ডাঙ্গে গুরগুরি ট
ভ্যাঁঙ্গে দিব ।“
উয়ারা শেষ ত্বক্ক গুড়ুপুটলু আর
লোজে গবুরে হ্যঁয়ে গেল ।
আই আইজ্ঞা লালু বাউরী
সাকিম মোকাম আগরাবাইদ
লিজের হাতে চাষ আবাদ কর্যে ধান
ফ্যলাইছি ।
মাথার গাম পায়ে ফেল্যাঁই খিদা
তিষ্ঠায় পুড়্যে গেইছে বুক
মাটি ফাটা রোদে ধুড়স্যে গেইছে গতর
কড়ক লাগা কামরে হাল ঠোলেছি সকাল
থ্যাকে সনঝ্যাতক্ক ।
ইখন সি জমিতে হলুদ বন্ন ধান
মনে লিছো আর দুঃখু থ্যাকবেক নাই
হে ।
খুন চুষা বাঘের পারা অভাবটো
হুঁকারছো ত হুঁকারছোই
উটোকে লেত্যাড়ে মারতো শুরু হঁয়ে
গেইছে
গাঁ গঞ্জে চারদিগের লে মাড় ভাতের
লড়াই ।
কেউ তা জানে না
দিনের ভিতরেও একটা দিন এবং রাতের
ভিতরেও একটা রাত থাকে ।
আমরা তাদের কেউ দেখি না শুধু কথা
শুনতে পাই
সেই কথার ভেতরেও অন্য কথা থাকে
আমরা কেউ তার ভাষা বুঝতে পারি না
।
দিন আর রাত নিয়ে আমাদের পথ চলার
শেষ নেই
পথের আবার কিছু পথ আছে কথা আছে
আমরা কি কখনো জেনেছি ?
পথের ভিতরে থেকে পথ উঠে এসে
হ্যান্ডসেক করে
কুশল সংবাদ জানতে চায়
আর তার কথায় কথায় আমার ভেতর থেকে
অন্য কেউ খিল খিল হাসে
ছুটে আসা ঢেউ কখনও দিন ও রাতের রঙ
পালটে দিতে চায় ।
তখন দিনের ভিতরে দিন রাতের ভেতরে
রাত সাদা হয়ে যায় ।
আমি তাদের ভাষাগুলি ইচ্ছে মতো
অনুবাদ করি
ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিই আত্মঘাতী
নিষাদের তীর
কেউ তা জানে কি ?
অমল মৃত্যু থেকে
আমি তো আমার শব কাঁধে নিয়ে হেঁটে
যাচ্ছি শ্মশানের দিকে
আমি আমার মুখাগ্নি করে আমাকে
পোড়াবো
কিছু ফুল ছুঁড়ে দেবো নিজেই দু
হাতে
ওঁ শান্তি উচ্চারণে বার বার
দিগন্ত কাঁপাবো ।
না কোনও কান্না নেই শোক নেই
নিরালম্ব অন্ধকার শূন্যের গভীরে
বিশাল শূন্যতা এক কাছে ডেকে গল্প
শোনাবে
সে গল্পে শুনবো আমি আদি অন্তহীন
এক শিকড়ের ভাষা
আমিই আমার শেষ শববাহক আমাকেই
কাঁধে নিয়ে চলেছি শ্মশানে।
আকাশের চাঁদ আর আগুন আমাকে দেখে
জানায় কুর্নিশ
আগুনে আগুনে পুড়ে আমি যে আগুন হয়ে
যাই
চিতা কাঠে শ্লেটে লেখা হয় যে কটি
অক্ষর
সেখানেই জীবনের পরিচয়
আদি মৃত্তিকার গন্ধে নম্রতার
নিঃশব্দ ভুবন।
আগুন আত্মার ধ্বনি সারাৎসার
নিজেকেই দিই পূর্ণাহুতি
সে আমাকে ফিরিয়ে দেয় নতুন জন্মের
ঋতু
প্রিয় সন্তানের মুখে বাতাবি লেবুর
গন্ধ
হাস্নাহানার হাসি হিরন্ময় দ্যুতি
।
অমল মৃত্যু থেকে আমিই ছিনিয়ে আনি
ফুলের উদ্ভাস আর সৃষ্টির নিশান ।
শ্রেনীযুদ্ধ
আমার ভেতরে যেন অন্যকেউ আছে।
আছে নাকি ?
হাত-পা নাড়ে কথা বলে ভিন্ন ভাষায়
সমাজ ভাঙতে চায়
মার খাওয়া মানুষের মুখে
তুলে দেয় ভিন্ন ভাষা ভিন্ন
কন্ঠস্বর ।
রণমুখী বুকের ভেতরে তাই প্রতিদিন
তুমুল সংগ্রাম
সে মানুষ জানে
জানে সে বলেই আমার ভেতরে থাকে
সর্বদা প্রস্তুত
বিদ্যুৎ বিদীর্ণ করে
গায়ে মাখে উল্কার আগুন
শান্ত সমুদ্রে তুলে ঢেউ ।
আমার ভেতরে যেন আছে অন্য কেউ
শ্রেনীসংগ্রামের বীজ রক্তে বুনে
বুনে
তারপর হঠাৎ বেরিয়ে পড়বে
নিজের থেকেও বড় ছায়া ফেলে কঠিন
রাস্তায়।
জরিপ
মাটি ফুঁড়ে মাটির ভিতরে চলে যাবো
দেখে নেবো কোথায় রহস্য কতটুকু?
বহুদূর প্রসারিত আমার এ কঠিন শিকড়
।
আমার তো মান-অপমান কিংবা
নিন্দা-ভয় নেই ।
নিন্দিত নন্দিত আমি
ক্ষীরে ক্ষীরে গড়ে ওঠা আমার জীবন
পাঁকে ও পঙ্কজে থেকে স্বেচ্ছায়
নিয়েছি তুলে অন্ধকার আলো ।
মাটি ফুঁড়ে মাটির গভীরে চলে যাবো
ছুঁয়ে ফেলবো অন্তিম শিকড়
জন্মেই দেখেছি শুরু, শেষ কোথা আমি
দেখে যাবো।
আমাকে ডেকেছে আজ আমার চলার ছন্দে
আমারই গড়ে তোলা স্বপ্নের বাগান
প্রতিরোধ ভেঙে তাই বুকের ফুটন্ত
ফুলগুলি
ছুঁয়ে থাকে আমার নিশান ।
নচিকেতা
সমবেত দুঃখ নিয়ে এসো হেঁটে যাই হেঁটে যেতে যেতে
দুঃখগুলি গান হয়, গানে গানে
পাথুরে স্তব্ধতা
ভেঙে যায় ক্রমাগত জেগে ওঠে
উদ্গ্রীব চেতনা।
আগুনের জামা পরে দীর্ঘ পথ হেঁটে
গেলে যন্ত্রনা থাকে না।
পুড়ে যায় অভিমান আবর্জনা-স্তুপ
শোকের বিরুদ্ধে আমরা সেই নচিকেতা
মৃত্যুকে জয় করে ফিরে আসি চমকে
দিয়ে যমের দুয়ার।
সমবেত দুঃখগুলি আনন্দের গান হয়ে
এক সময় গোলাপ ফোটায়
গোলাপে রক্তের দাগ কখনো থাকে না
ধারালো কাঁটার ডগে সেঁটে দিই
আগুনের উজ্জ্বল পোস্টার ।
আমরা নচিকেতা মৃত্যুকে হজম করে
বসে আছি
ঝড় বৃষ্টি বজ্রপাত পরোয়া করি না
লজ্জায় মাথা নীচু করে যমরাজ চলে
যায়
নিজস্ব নিলয়ে।
হায় ভারতবর্ষ তোর বুকে যে আগুন কে
তাকে জুড়ায় ?
আমাকে অস্থির করে স্মৃতির নীলিমা
যতবার এগিয়ে যাই ততবার পিছনে কে
টানে?
এ টানের কোনো কিছু অর্থ বুঝি না
চলতে জানাটাই একটা কঠিন জীবন
সমস্ত নিয়ম ভেঙে চলতে গেলে সজোরে পিছনে
পড়ে টান ।
ছত্রখান হয়ে যায় স্বপ্নের বাগান
পোষা পাখি সেও যেন অন্য কথা বলে
পায়ে পায়ে বাজতে থাকে শক্ত শিকল
ছিঁড়তে পারি না আমি শিকলের
নিষ্ঠুর শাসন।
লাল মাটির যৌবনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে
কালো মেঘ ।
মেঘে মেঘে বৃষ্টি মাদল
সমস্ত খিলান খুলে সব কিছু আলগা
করে দেয়
কী করে গুটিয়ে রাখবো শিকড়-বাকড়
ডাল পাতা ফুল?
পায়ের নীচের সিঁড়ি সরে যায়
বিশাল আকাশ ছুঁতে দু হাতে পারি না
কে যেন পিছনে টানে কেড়ে নেয় চলা
বিশাল শূন্যতা এসে আঁকড়ে ধরে
দরোজা বন্ধ হয়
রক্তের গভীরে ঢেউ উথালপাথাল
আমাকে অস্থির করে স্মৃতির নীলিমা
।
বয়স বেড়েছে তবু
এইমাত্র ফুলের বাগান থেকে বাইরে
এলাম
এইমাত্র গায়ে লাগলো গোলাপের ঘ্রাণ
তুমি সেই ফুলগন্ধে মাতোয়ারা
আমার বুকের মধ্যে বুক রেখে ফিরে
গেলে দুরন্ত যৌবনে।
রক্তের ভিতরে কিছু ভালবাসা
অঙ্কুরিত বীজ
বুক জুড়ে অমল প্রত্যাশা
তোমার দিঘল চোখে স্বপ্নগুলো ঢেউ
তোলা নদী
ছায়া ছায়া ভোরের মিছিল
তৃপ্তির অহংকারে দু আঙুলে ছুঁয়েছে
আমাকে।
এইমাত্র ফুলের বাগান থেকে বাইরে
এলাম
গোলাপের গন্ধা গায়ে মেখে
তুমি সেই ফুলগন্ধে ফিরে পেলে
তোমার যৌবন
কিছু স্মৃতি কিছু সুখ ভালোবাসা
অমল প্রত্যাশা
এখন তোমার চোখে ঢেউ-তোলা নদী
ইশারায় ডাকাডাকি করে ।
বয়স বেড়েছে তবু বুঝতে পারি
সাংকেতিক ভাষা
দুলে ওঠে নিশ্চল পাথর ।
বিপ্লব কি ঘুমিয়ে গেছে
বিপ্লবী গেছে ফুলের বাগানে যেখানে
ডাকছে কোকিল...
যুদ্ধ এখন আগুনের ফুলঝুরি
মহুল মদিরা যৌবনে আনে সুর
মৌমাছিদের জলসায় নাচে হেসে হেসে
ভুঁই পরী ।
মঞ্চে নাটক... লাল নীল আলো যতো সব
নীতিমালা।
নিয়ম ভাঙার ঘন্টা বাজছে ঝরে পড়ে
ঝুলকালি
মন্ত্রীরা দেখে রঙিন স্বপ্ন
নেতারা নাচায় ছড়ি
রাজহাঁস দেবে সোনার ডিম্ব
মূর্খ জনতা হাত পেতে আছে বেহিসেবী
হাতখানি ।
বিপ্ল্ববী গেছে ফুলের বাগানে
যেখানে ডাকছে কোকিল –
নব বসন্ত সেখানে ছড়ায় প্রেমের
গোপন চিঠি
অশোকে কৃষ্ণচূড়ায়
সেখানে কামিনী কাঞ্চনে ভুলে
ঝরা পাতাগুলি কেমন দুহাতে কুড়ায় !
বিপ্লব নেই
কাস্তে হাতুড়ি বুনো বিছানায় ফুলে
ফুলে আজ ঘুমায়
হারিয়ে যাচ্ছে চিমনির ধোঁয়া
ক্রেনের শব্দ- শস্যগন্ধী হাওয়া
বন্ধ্যা মাটিতে চিল চিৎকার-
পতাকায় দোল খায়
ছেঁড়া স্বপ্নেরা তোমার আমার
কোথায় এখন আগুনেতে ভরা রাগী সেই
মুখগুলো ।
বিপ্ল্ববী গেছে ফুলের বাগানে,
রূপসী সে রাজনীতি
রঙিন ঘাঘরা ওড়ায়
ঝলকায় বুকে মন্দার ফুলহার ;
বিপ্ল্বব হাঁটে ক্রাচে ভর দিয়ে
এলোমেলো রাস্তায়
তবুও অহংকার ?
আদিম পশুরা মটকে দিচ্ছে
গণতন্ত্রের ঘাড় ।
মানুষের বুকে জোয়ান রক্তে ক্ষোভে
ঝড় গর্জায় ।
ছেলেটা
যে ছেলেটা খাঁচা ভেঙে আকাশে উড়িয়ে
দিলো আগুনের পাখি
আদম আর ঈভের বাগানে রেখে এলো আগুন
সে এখন বুকে মাইন বেঁধে ঝাঁপিয়ে
পড়তে পারে যে কোনও শিবিরে
কেড়ে নিতে পারে মাঝ রাতের ঘুম ।
যে ছেলেটা আবেল আর কেইনের জন্ম
সহোদর
সে এখন যে কোনও নারীর স্বপ্ন চুরি
করে নীল নখ উপড়ে নিতে পারে
চাঁদ আর শিউলি ফুল
মানুষের দিন দিন জমে থাকা পাপ
ল্যান্ড মাইনে উড়িয়ে দিতে চায়
এক লহমায় ।
যে ছেলেটা জন্ম থেকেই শুনেছে
ক্ষুধার মর্মর তাকে কি ভুলিয়ে রাখতে পারে
বন মহুয়ার ঘ্রান?
রক্তে ভেজা মাটিতে ভেজা দীর্ঘশ্বাস-
গোলাপে গোলাপে প্রবঞ্চনা
ছিঁড়ে খুঁড়ে দেয় সৃষ্টির নিশান ।
ভারতবর্ষ তোমাকে ছোবল মেরে নীল
করে দিচ্ছে ভিন দেশী ঢেউ
ছেলেটা জেনেছে সে এখন সিলভার
ড্রাগন
ইরাকী গণতন্ত্র মরু শেয়ালের হাসি
স্তব্ধ করতে চায় হিংস্র থাবায় ।
সুজাতার থালা নেই
ওরা সব স্বপ্নে সোনার ভাত রান্না
করে ফুটপাতে ঘুমায় ।
ঘুমায় কি? পেটের আগুন ঘষে
এভাবে আগুন জ্বালে ভাত ফোটায়
রান্নাবান্না করে ।
ওরা চিরকাল নিজেকে পুড়িয়ে
আগুনের পরিপূর্ন মূর্তি হতে চায় ।
ওদের ভাতের স্বপ্নে রাত কাটে দিন
কেটে যায়
কখন দুধের বাটি বিড়ালেরা খায়
জানতে পারে না
মায়ের কপাল ভেঙে ছেলেরা পুতুল গড়ে
ন্যাংটো ছেলেরা খেলনা চায়
জামাকাপড় শ্লেট ও পেন্সিল
চায় ওরা সামান্য চাঁদের আলো রাতের
পাঠশালা ।
ওদের খাবার নিয়ে কখনো আসে না কোন
সুজাতার থালা
অথচ বুদ্ধের চেয়ে সুখ শান্তি
রাজ্যহারা
বড়ো বেশি ওরা সব কঠিন সন্ন্যাসী ।
একদিন
একদিন সব যুদ্ধ থেমে যাবে পাখিদের
গানে গানে
শুরু হবে বসন্ত বিকাশ
অস্ত্রের ডগায় ফুল ফুটে উঠবে
প্রজাপতি উড়ে বসবে রঙিন ডানায় ।
পৃথিবীর সমস্ত রাইফেল বোমা বেয়নেট
রকেট লঞ্চারগুলি
মানুষকে কুর্নিশ জানাবে ।
একদিন সমস্ত নদী ধ্বংসের দামামা
ভুলে ঢেউ তুলে সমুদ্রে পৌঁছাবে।
উর্বরা মাটিতে হাসবে শস্যমুখ,
শোনা যাবে জননী-যন্ত্রনা
ফুলের ফসল আসবে ঘরে ঘরে উলু আর
শঙ্খধ্বনিতে
শুরু হবে গোবর মাড়ুলি আর পিটুলি
বাটার আলপনা ।
একদিন নারীর নরম কন্ঠে শোনা যাবে
প্রণয়ের গান
স্বপ্নের সিঁড়িতে রোদে ভালবাসা
ছলকে পড়বে
হেসে উঠবে ঘর গেরস্থালি আর সুখের সংসার
খেলা করবে আমাদের রক্ত আর মাংসের
সন্তান।
একদিন বাসভূমি ভেঙে দিয়ে গড়ে উঠবে
বাসভূমি
জন্মভূমি রৌদ্র আলো ঝঙ্কারিত
সুন্দরের প্রতিমা সাজাবে
ঘাতক প্রেমিক হবে দস্যুতার
বিসর্জনে বাজনা বাজিয়ে
পৃথিবীর প্রেমিকেরা শান্তি শান্তি
ওঁ শান্তি মন্ত্র শোনাবে ।
একদিন সব পতাকার রঙ এক হয়ে কথা
বলবে একটি ভাষায়
সমস্ত শ্লোগান হবে মহাজীবনের গান
সব সমানের জন্যে স্বনির্ভর
মেরুদন্ড খাড়া টানটান হয়ে
নক্ষত্রের পান্ডুলিপি জ্যোৎস্নায়
ছড়াবে।
যে ধর্ম পুড়ায় ফুল তার জন্যে ঘরে
ঘরে পৌঁছে যাবে দূরন্ত জেহাদ ।
একদিন ঈশ্বর ও শয়তানের প্রতিদ্বন্ধী
মানুষেরা
আগুনের বেড়া টপকে ঘরের দেয়ালে
সাঁটবে
দু ইঞ্চি পেরেক ঠুকে উজ্জ্বল
পোস্টার ।
পালতোল ডিঙি নাচাই
পাথর ফেটে ছিটকে বেরিয়ে এলো জল
জলের একটিই ভাষা সমুদ্র ছোঁবার
গান
নদী জানে মাটি জানে
জানে নক্ষত্রখচিত আকাশ ।
ফুলের পাপড়িতে পাপড়িতে গন্ধে ভরা
সেই একটিই ভাষা
জানে প্রজাপতি মৌমাছি
সকালের ডানামেলা পাখি
আমরা রাষ্ট্রসীমা ভেঙে দাঁড়িয়ে
থাকা মানুষ
বুকে পুষে রেখেছি সেই ভাষার গোপন
অহংকার ।
পাথর আর ফুল আপন আপন মাতৃভাষায়
কথা বলছে
আমরা সেই একটি ভাষায় সমুদ্র
ছোঁবার গানে গানে
ছপছপ দাঁড় টেনে জলের উপরে
পালতোলা ডিঙি-নাচাই ।
যাওয়া হোলো না
কোথায় আমার যাবার ছিল আমার কিন্তু
যাওয়া হলো না...
কি যেন সব বলার ছিল কিছুই আমার
বলা হলো না
বাউন্ডুলে বাতাস এসে আমার চলা
থামিয়ে দিলো
দু পায় কাদা লেপ্টে গেলো, ভ্রমণ
যেন পথ হারালো
পথের ভিতর পথ লুকিয়ে কোন ঘরে মুখ
ঢাকালো।
চোখ খুঁজছে আলোর রেখায় দূরের কোন
ঠিকঠিকানা !
রাতের তারা গাইছে কি গান? পাতায়
সুরের ঝর্নাধারা
চাঁদের সভা ভাঙলে যেন দেয় কে একা
রাতপাহারা ?
উল্কাপাতে স্বপ্ন পুড়ে, তবুও এ
বুক অহংকারী
আমার গোলাপ বাগানবাড়ি
আকাশ ছুঁতে ঘ ন ঘন নাচায় সুখে
রঙিন ডানা
আমার কিন্তু বুক ভেঙে অন্য কোথাও
যাওয়া হলো না ।
যাওয়া হলো না বলেই যেন দুলছে রঙিন
নকশা শাড়ি
বাজছে কোমল হাতের চুড়ি
দুষ্টূ চোখের সেই চাহনি ‘কেমন মজা’ বলছে হেসে
এখন আমি স্বেচ্ছাবন্দী দারুণ
শ্রাবন সর্বনাশে
ঘরে ভেসে যায় মন ভেসে যায় তৃষ্ণার
জল হয় যে লোনা ।
কোথায় যেন যাবার ছিল আমার কিন্তু
যাওয়া হলো না
যাওয়া হলো না
যাওয়া হলো না
যাওয়া হলো না
********************************
(উপস্থাপনা : রমিত দে। কাব্যগ্রন্থ ও তথ্য সংগ্রহে
বিশেষ ঋণস্বীকার- কবিপুত্র শ্রী বিপ্লব
গঙ্গোপাধ্যায়, কিংশুক পত্রিকার তরফে সানি সরকার, অর্থিতা মন্ডল)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
মাটির মানুষ মোহিনীদাকে নিয়ে এই সদর্থক লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে যাঁরা কবিতা নিয়ে কখনও ভাবেনি তাঁরাও এই লেখাটা পড়ে অন্তত একটু ভাববেন । জীবনের অবিচ্ছেদ্য কিছু মরমি উচ্চারণ ঘনীভূত হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায় ।সময় ও সংঘাতের বিপন্ন মুহূর্তে আমাদের অস্তিত্বের জাগরণ ঘটেছে তাঁর কবিতায় । সেই বিন্যাস থেকেই যাপিত জীবনের উপলব্ধি এই এই লেখাটার মুল বিষয় ।
ReplyDeleteMonta praptir anande vore gelo
ReplyDeleteবাবাকে লেখাটি পড়ে শোনালাম আজ । শুধু এই লেখাটি নয় বেশকিছু লেখা । খুব উৎসাহিত বোধ করলেন বাক নিয়ে ।আপ্লুত হলেন । কেবল ওয়েব দুনিয়ায় নয় এই ধরণের কাজ মুদ্রিত জগতেও দুর্লভ । একদল শক্তিমান তরুণ তুর্কির হাত ধরে বাক এগিয়ে চলেছে দূর্বার ।
ReplyDeleteAponjoner porosh mon doriya chhue jay. Dheu bihin torongo othe hridsomudre.
ReplyDeleteপ্রগাঢ় অনুভূতি অন্বিত রচনা।
ReplyDeleteপ্রগাঢ় অনুভূতি অন্বিত রচনা / পার্থপ্রতিম আচার্য
ReplyDelete